চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ঘটে যায় গোটা ঘটনাটা। ৪ বছরের লিজা। মায়ের সঙ্গে যাচ্ছিল স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে। তখনই আকাশ থেকে পড়ল রাশিয়ার মিসাইল। বদলে গেল মা আর মেয়ের পথ। শেষ হয়ে গেল লিজাকে নিয়ে বহু বহু পরিকল্পনা।
৪ বছরের লিজা। চিকিৎসকের কাছে তার যাওয়া হয়নি। আর কখনও যেতেও হবে না। লিজা থেকে যাবে ইন্টারনেটে একটি ভাইরাল ছবি হিসাবে। লিজা থেকে যাবে যুদ্ধের বীভৎসতার একটি প্রতীক হিসাবে।
ইউক্রেনের ভিনিতসিয়ায় বৃহস্পতিবার আছড়ে পড়েছে রাশিয়ার ক্ষেপনাস্ত্র। তাতে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। তার মধ্য একজন লিজা। ২৩ জনের মধ্যে আছে দুই বালকও।
বীভৎস বিস্ফোরণ! তার পরেই মা আ মেয়ের যাত্রাপথটি বদলে গিয়েছে। মা ইরিনাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এক হাসপাতালে। লিজার স্থান হয়েছে মর্গে। ইরিনার কাকিমা তেতিয়ানা দিমিত্রিসিনা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ইরিনার মনে আছে, ও মেয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তত ক্ষণে লিজার মৃত্যু হয়েছে। মায়ের সবচেয়ে দামি জিনিসটিই চুরি হয়ে গেল।’
লিজার মৃত্যুর কিছু ক্ষণ আগে রেকর্ড করা কয়েকটি ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় তখই পোস্ট করেছিলেন ইরিনা। নীল জিন্সের জ্যাকেট পরে মনের খুশিতে ভিনিতসিয়ার রাস্তায় চলেছে লিজা। ল্যাভেন্ডার ফুলের মাঝে আনন্দ করছে। কিন্তু তার কিছু ক্ষণ পরের ভিডিয়োও ছড়িয়ে পড়েছে এই সোশ্যাল মিডিয়াতেই। রাশিয়ার ক্ষেপনাস্ত্র হানার পরে ইউক্রেনের ইরাজেন্সি সার্ভিস কয়েকটি ছবি প্রকাশ করেছে। সেই একই নীল জিন্সের জ্যাকেট, তলায় ল্যাভেন্ডার রঙের স্কার্ট পরা লিজার ছবি সেখানেও আছে। কিন্তু সেই ছবিতে লিজার প্রাণ নেই।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের স্ত্রীও জানিয়েছেন, লিজার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। একবার বড়দিনের জন্য শিশুদের নিয়ে ভিডিয়ো শ্যুট করা হয়। সেই দলে ছিল লিজাও। ওলেনা জেলেনেস্কি লিখেছেন, ‘আধ ঘণ্টা ধরে লিজা তার নিজের জন্য পোশাক সুন্দর করে রং করে। শুধু নিজের না, বাকি শিশুদের, আমার, আমাদের ছবির ক্যামেরাম্যান, পরিচালক— সকলের জন্য পোশাক তৈরি করে দেয় সে।’ এই লেখার সঙ্গে পুরনো ভিডিয়োটির ঝলকও পোস্ট করেছেন ওলেনা।
যুদ্ধ শুরু সময়ে ইলিনা তাঁর মেয়ে এবং পরিবারের অন্যদের নিয়ে কিভ থেকে চলে যান। ২৬৮ কিলোমিটার দক্ষিণে ভিনিতসিয়ায় থাকতে শুরু করেন তাঁরা। এর আগে পর্যন্ত এই শহরটিকে তুলনামূকভাবে নিরাপদ বলেই মনে করা হত। কিন্তু সব হিসাবই এলোমেলো হয়ে গেল বৃহস্পতিবারের ঘটনায়।
এখন ইলিনার বয়স ৩৩ বছর। যখন তাঁর বয়স ২৯ বছর ছিল, তিনি লিজার জন্ম দেন। জন্ম থেকেই লিজার হৃদযন্ত্রে একটি সমস্যা ছিল। এছাড়াও ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিল লিজা।
লিজার মাসিও লিখেছেন, ‘ও খুব ফুটফুটে ছিল। ওর উপস্থিতিটাই ছিল খুব উজ্জ্বল। অনেকে মনে করেন, যাঁদের ডাউন সিনড্রোম থাকে, তাঁরা অনেক কিছুই বুঝতে পারেন না। কোন কাজ কীভাবে করতে হবে, তা তাঁরা বুঝতে পারেন না। কিন্তু এটি একেবারেই সত্যি নয়। লিজা খুব উজ্জ্বল একটি মেয়ে ছিল। ও জানত, কীভাবে ছবি আঁকতে হয়, কীভাবে বড়দের সাহায্য করতে হয়। আর ওর মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত। সব সময়ে ও থাকত আনন্দে পরিপূর্ণ।’ লিজার মাসি এর পরে লিখেছেন, ‘ওর মায়ের কাছে ও ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দামি উপহার।’
একটি বিস্ফোরণ সেই সব কিছু এলোমেলো করে দিল। এখন ভিনিতসিয়ার ওই জায়গাটিকে ঘিরে রাখা হয়েছে। মানুষ আসছেন। মানুষ ফুল দিয়ে যাচ্ছেন। মোমবাতি জ্বালছেন তাঁরা। কেউ কেউ রেখে যাচ্ছেন টেডিও। প্রতিটি মায়ের আশঙ্কা, তাঁদের আতঙ্কের রূপক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে ভিনিতসিয়ার বিস্ফোরণ স্থলটি।
বহু মা আসছেন, ওই জায়গাটি দেখতে, যেখানে প্রাণ হারিয়েছে লিজা। এমনই একজন হলেন ক্যাটেরিনা কোনদ্রাতিউক। বিস্ফোরণস্থলে এসে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, যুদ্ধ তো এমনই, যেখানে নিরপরাধ শিশুদের প্রাণ যায়।
লিজা এখন মর্গে। পরিবার তার মরদেহ পাওয়ার অপেক্ষায়। কাগজপত্রের কাজ মিটলে তাঁধের হাতে তুলে দেওয়া হবে লিজার দেহ। তার পরে মাটিতে মিশে যাবে লিজা। কিন্তু তার পরেও থেকে যাবে সে। যুদ্ধের বীভৎস হিংসুটে একটা মুখের শিকার হিসাবে।