প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের ওপর মানব সভ্যতার খবরদারি যত বেড়েছে, বিপন্ন হয়েছে তার স্বাভাবিক চরিত্র। এখন যেন ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। কোথাও বন্যা তো কোথাও চরম তাপপ্রবাহ, আজকের জলবায়ু সংকটের অন্যতম চিত্র এমনই। আর এবার তুলনামূলক কম উষ্ণতাযুক্ত জুলাইতেও বিশ্বজুড়ে তীব্র গরম। বিশ্ব জলবায়ু সংস্থার মতে, ২০২৩ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ রেকর্ড গড়ল উষ্ণতার নিরিখে। এই বছর ইতিমধ্যেই উষ্ণতম জুন মাস প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনোর প্রাথমিক প্রভাবে এমন চরম উষ্ণতা দেখা যাচ্ছে জুলাইমাসে।
স্পেনে খরার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানকার মানুষ এবং চিনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ভয়ঙ্কর তাপপ্রবাহ দেখা গেছে, যা অতীতের সাপেক্ষে রেকর্ড। ‘প্রাথমিক তথ্য অনুসারে এই চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম সপ্তাহের রেকর্ড গড়েছে’ বলছে বিশ্ব জলবায়ু সংস্থা (ডব্লিউএমও)। একটি বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশের ওপর সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক প্রভাবের ফলে স্থল ও মহাসাগরে তাপমাত্রার রেকর্ড বৃদ্ধি হয়েছে।
‘আমরা এখনও জানি না কি হয়ে চলেছে এবং এল নিনোর প্রভাব আরও বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়ার রেকর্ড বৃদ্ধি ঘটতে পারি। এই প্রভাবগুলি ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলতে পারে’ এমনই জানিয়েছেন ক্রিস্টোফার হিউইট। ক্রিস্টোফার বিশ্ব জলবায়ু সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর।
‘এটি পৃথিবীর জন্য বেশ উদ্বেগজনক খবর।’ হিউইট বলেন। মে এবং জুন দুই মাসেই বিশ্বজুড়ে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছিল। শুধুমাত্র সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নয়, পুরো মহাসাগরের উষ্ণতাই ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রয়েছে। ডাব্লুএমও-এর বিশ্ব জলবায়ু গবেষণা কর্মসূচির প্রধান মাইকেল স্প্যারো বলেছেন, ‘যদি সমুদ্রের উষ্ণতা এভাবে বৃদ্ধি পায়, তাহলে এটি বায়ুমণ্ডলের ওপর, জলভাগের বরফ এবং বিশ্বব্যাপী বরফের সঞ্চয়ের ওপরও প্রভাব ফেলবে।’ জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি এই বছরের উষ্ণতা বৃদ্ধির আরও একটি কারণ এল নিনো। স্প্যারো এ’প্রসঙ্গে বলেছেন এল নিনোর প্রভাব সম্ভবত বছরের শেষের দিকে আরও তীব্রভাবে অনুভূত হবে।
ইউরোপের জলবায়ু পর্যবেক্ষণ পরিষেবা সংস্থা ‘কোপার্নিকাস’ এএফপি নিউজ এজেন্সিকে বলেছে তাদের ডেটাও দেখাচ্ছে যে ১৯৪০ সালের পরবর্তী সময়ে হিসেব করলে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহই ছিল সর্বাধিক উষ্ণতাযুক্ত। তাপপ্রবাহজনিত মৃত্যু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়েছে বলছে পরিসংখ্যান। হিটস্ট্রোক এবং ডিহাইড্রেশন থেকে শুরু করে কার্ডিওভাসকুলার স্ট্রেস, নানান গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিয়েছে এর ফলে।
সোমবার প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে যে ২০২২ সালে ইউরোপে রেকর্ড উষ্ণতার কারণে ৬১,০০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। নেচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, বেশিরভাগ মৃত্যুর ক্ষেত্রে ব্যক্তিদের বয়স ৮০ বছরের বেশি এবং গরমের কারণে মারা যাওয়া প্রায় ৬৩ শতাংশ মহিলা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমশ চরম আকার ধারণ করায় হিটস্ট্রোকের মতো ঘটনা আরও বাড়তে পারে। অর্থাৎ, জলবায়ু সংকটে যেমন বিপদে বিশ্বব্যাপী জীবকূল, বিপদে ‘উন্নততম’ প্রাণী মানুষও।