প্রস্তুতি শুরু লোকসভা নির্বাচনের। এ'রাজ্যের উত্তরবঙ্গে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রটি সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক সংঘাতের অন্যতম ভরকেন্দ্র। কোচবিহার জেলার সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র গঠিত। মাথাভাঙা, কোচবিহার উত্তর, কোচবিহার দক্ষিণ, শীতলকুচি, সিতাই, দিনহাটা ও নাটাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রটি গঠিত। এর মধ্যে মাথাভাঙা, শীতলকুচি ও সিতাই এই তিনটি কেন্দ্র তফশিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত। বর্তমানে এই লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ১৬ লক্ষেরও বেশি।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালের নির্বাচনে এই অঞ্চলটি উত্তরবঙ্গ লোকসভা আসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৫৭ সালে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র, নতুন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব ১৯৫৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সন্তোষ ব্যানার্জি এই কেন্দ্রে জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে লোকসভায় কংগ্রেসের থেকে এই আসনটি ছিনিয়ে নেয় ফরওয়ার্ড ব্লক। ফরওয়ার্ড ব্লকের দেবেন্দ্রনাথ কার্জি এই আসন থেকে জয়লাভ করেন। কংগ্রেসকে হারিয়ে ১৯৬৭ সালে বিকেডি চৌধুরী ফরোয়ার্ড ব্লকের পক্ষ থেকে ফের জয়লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরবর্তীতে দেশজুড়ে কংগ্রেসের ভোট ফের বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায়। কোচবিহারেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিনয়কৃষ্ণ দাসচৌধুরী আসনটিতে জয়লাভ করেন। তবে এর পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে ফের এই আসনটি ফরওয়ার্ড ব্লক ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেসের কাছ থেকে।
প্রসঙ্গত ১৯৭৭ সময় পর্বেই রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে। বাংলার জনমত কংগ্রেসের বিপক্ষে গিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৭ সাল থেকে পরবর্তী আটটি লোকসভা নির্বাচনে এই লোকসভা কেন্দ্র থেকে লাগাতার জয়লাভ করেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী অমরেন্দ্রনাথ রায় প্রধান। এই পর্যায়ে লোকসভা নির্বাচনে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে ভোটদানের হার ছিল গড়ে আশি থেকে নব্বই শতাংশ। ১৯৯৬ সালে এই লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে অমরেন্দ্রনাথ রায়ের জেতা আসনটি ২০০৪ সালে ফের ফরওয়ার্ড ব্লক-এর পক্ষ থেকে জয়লাভ করেন হিতেন বর্মন। রাজ্য রাজনীতিতে ১৯৯৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকেই প্রাসঙ্গিক হয় তৃণমূল কংগ্রেস, ফলে তাদের ভোটের হারও বাড়তে থাকে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে ফরওয়ার্ড ব্লক-এর পক্ষ থেকে রিপেন রায় এই আসনটিতে ফের জয়লাভ করেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের দীর্ঘ ১২ বারের জেতা আসন ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। টিএমসি প্রার্থী রেনুকা সিংহ ৫ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষের জনসমর্থন পান এই নির্বাচনে। তিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দীপক কুমার রায়কে ৮৭ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে এই লোকসভা নির্বাচন থেকে বিজেপির ভোটের হার বৃদ্ধি পায়। বিজেপির প্রার্থী হেমচন্দ্র বর্মন তৃতীয় স্থান অর্জন করলেও বিজেপির ভোট ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
এরপর ২০১৬ সালের উপনির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেস এই আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়। মধ্যবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য রাজনীতিতেও তুলনামূলকভাবে প্রাসঙ্গিক হয় ভারতীয় জনতা পার্টি। বিশেষত উত্তরবঙ্গে একসময় ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্ত ঘাঁটিতে বিজেপির প্রাধান্য বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের অধিকারী প্রসাদ চন্দ্রকে ৫২ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করেন 'একদা তৃণমূল কংগ্রেসের যুবনেতা' বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক। বিধানসভা আসনের নিরিখ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে শীতলকুচি এবং সিতাই বিধানসভা কেন্দ্র দুটিতেই কেবল এগিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের শেষ পাঁচটি লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটদানের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যেখানে ছিল ৮০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষের ভোট দান করেছিলেন, সেখানে প্রত্যেকটি নির্বাচনে দুই থেকে তিন শতাংশ ভোট দানের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৯১.২ শতাংশে, যা একদিক থেকে সদর্থক পরিসংখ্যান।
এবার দেখে নেওয়া যাক ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে কোচবিহারের জনমত কোন দিকে ছিল। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ২০২১-এর নির্বাচনে বিজেপিকে অনেকটাই এগিয়ে রাখলেও রাজ্যজুড়ে ফের তৃণমূল কংগ্রেস ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তবে, উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রেও এর প্রভাব পড়ে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে মাথাভাঙ্গা কেন্দ্রটিতে ২৫ হাজারের বেশি ভোটে জয়লাভ করেন ভারতীয় জনতা পার্টির সুশীল বর্মন, কোচবিহার উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির সুকুমার রায় ১৪ হাজারের অধিক ভোটে হারান নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। কোচবিহার দক্ষিণে নিখিল রঞ্জন দে ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে জয়লাভ করেন। একইভাবে শীতলকুচি, দিনহাটা এবং নাটাবাড়িতে কোথাও ১২ হাজার কোথাও ২৩ হাজারের অধিক ভোটে জয়লাভ করে ভারতীয় জনতা পার্টি। কেবলমাত্র সিতাই বিধানসভা কেন্দ্রটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জগদীশচন্দ্র বর্মা বাসুনিয়া জয়লাভ করেন।
দিনহাটা কেন্দ্রটিতে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে জয়ী প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক ফের জয় লাভ করলে পুনর্নির্বাচন ঘোষিত হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরের পুনর্নির্বাচনে এই কেন্দ্রটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীর উদয়ন গুহ ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ভোটে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনের নিশীথ প্রামাণিকের বুথেও বিজেপি মাত্র ৯৫টি ভোট পায়। এখন দেখার ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের এই গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা কেন্দ্রটি কার দখলে থাকে। নিশীথ প্রামাণিক ফের একবার জয়লাভ করবে এই কেন্দ্র থেকে। এক সময়কার ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্যপাটে তাদের ভোট শতাংশ কি কিছুটা বাড়বে? লড়াইয়ে আছেন নীতীশ চন্দ্র রায় ফব থেকে। তবে নিশীথের সঙ্গে মূল লড়াই হতে চলেছে তৃণমূলের জগদীশ চন্দ্র বর্মা বাসুনিয়ার। মোট ছয়জন প্রার্থীর মধ্যে হবে কোচবিহার থেকে সংসদে যাওয়ার লড়াই। ১৯ তারিখের ভোটগ্রহণের দিকেই এখন সবার নজর।