‘আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।’
সকালে খবরটা পাওয়ার পরে এটাই আমার প্রথম অনুভূতি। কানের অনেক গভীরে, মনের কোণে দমকা বেজে উঠল এই গানটাই। ‘আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।’
লতাজি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। উনি কতটা বড় মাপের একজন শিল্পী ছিলেন, ওঁর চলে যাওয়ায় কী কী ক্ষতি হল— সেই বিষয়গুলি অনেকেই অনেক কথা বলবেন। আমি বরং লিখি, উনি কেন থেকে যাবেন? উনি কেন আমাদের ছেড়ে কখনও কোথাও যাবেন না?
প্রথমে একজন পেশাদার সুরকার, সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে কয়েকটি কথা বলি।
কেন লতা মঙ্গেশকর অন্য শিল্পীদের অনেক দূর এগিয়ে?
প্রথমত, কোন শব্দে কতটা জোর দিতে হবে— এটা ক’জন শিল্পী ওঁর চেয়ে ভালোভাবে জানেন? এখনও যদি আমরা কাউকে গান বোঝাতে যাই, বা নিজেরাও কোনও গানের সারমর্ম আত্মস্থ করতে যাই, তাহলে ওঁর গলায় সেই গানটি শুনি। এর চেয়ে ভালো উপায় আর কীই বা আছে!
দ্বিতীয়ত, গানের ভাষায় যাকে বলে ‘হরকত’। অর্থাৎ স্পষ্ট উচ্চারণ। মদনমোহনজি হন, বা রাহুল দেব বর্মনই হন— যাঁর সুরেই গেয়েছেন, ‘হরকত’ নিখুঁত থেকেছে। মারাঠি হয়েও হিন্দি তো বটেই, দেশের অন্য যে কোনও ভাষায় যখনই গান গাইতে গিয়েছেন, লতাজি সেই ভাষাটিকে আত্মস্থ করে ফেলেছেন। গেয়েছেন নিজের মাতৃভাষার মতো করেই। শব্দের পর শব্দে ঝরে পড়েছে শৈল্পের পাশাপাশি সেই আত্মিকতাও। এটাই বা ক’জন পেরেছেন?
তৃতীয়ত, এবং হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, লতাজি যখন হাই অকটেভে গান গাইতেন, তখনও তাঁর কণ্ঠ ‘শ্রিল’ করত না। অনেক বড় শিল্পীরও গলা হাই অকটেভে তীক্ষ্ণভাবে ভাঙে। লতাজির কণ্ঠে তা কোনও দিন হয়নি। এটি যে কোনও সুরকারের কাছে যে কত বড় প্রাপ্তি, তা বলে বোঝানোর নয়। একজন মানুষ নিঃশ্বাস নিয়ে যে আরাম পান, লতাজি কোনও সুরকারের সুরে গাইলে, শেষ পর্যন্ত সেই সুরকারও তেমন আরাম পেতেন।
আর এই কারণগুলির জন্যই লতাজির গান শুধু শোনার জন্য নয়, গান শুনে শেখার জন্যও।
এবার আসি ব্যক্তিগত ক’টি কথায়।
অনেক বছর আগে একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিকে সুর দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপরে। সেখানে একটি ভজন ছিল। লতাজি সেই গানটি গাইবেন। উনি রেকর্ডিংয়ের জন্য এলেন। গান গাইতে যাওয়ার আগে আমায় বললেন, ‘আমার ভুল হলে তুমি বোলো।’
এর উত্তরে সেদিন কিছু বলতে পারিনি। ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম। সাক্ষাৎ দেবী সরস্বতী আমায় বলছেন, তাঁর ভুল হলে আমি যেন বলে দিই। এমন বিস্ময়কর কথা শুনে তাঁর পা দু’খানি স্পর্শ করা ছাড়া আর কীই বা বলতে পারতাম সেদিন! কারণ আমি জানতাম, গানটির সুরদান আমি করে থাকলেও, আমার চেয়ে অনেক বেশি করে সে গান আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন তিনি।
লতাজি কোথাও যাননি। যাবেনও না। যত দিন সিনেমার গান তো বটেই, সঙ্গীতচর্চা টিকে থাকবে, তত দিন তিনিও থাকবেন।
এক সময়ে ক্যাসেট প্লেয়ারের আমরা গান শুনতাম। তার ‘হেড’-এ ময়লা জমলে, সেটি পরিষ্কার করতে হত। লতাজি গোটা সঙ্গীত জগতের কাছে তাই। সকলের মাথা পরিষ্কার করে দেন উনি। সুর আটকে গেলে, কথা না জোগালে, ভাব না এলে— উনি এসেন দাঁড়ান। কানের কাছে এসে শিখিয়ে দেন সবটা।
আর সব শেখানোর শেষে?
বলেন, ‘আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।’
পুনরাগমনায় চ!
দেবী আবার আসবেন। বার বার আসবেন। থাকবেন আমাদের মাথায়। আমাদের কানে।