আজ 'তাঁর' জন্মদিন। বুধবার ১৬ জুন ৭১-এ পা দিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। বাংলা ছাড়াও হাতে গোনা যে কয়েকজন শিল্পী গোটা ভারতে জনপ্রিয় হয়েছেন মিঠুন নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তবে 'অন্যতম' না বলে কেউ যদি তাঁকে এক নম্বরও বলেন সেকথার প্রতিবাদও কারোর মুখ থেকে শোনা যাবে না। তাঁর অধিষ্ঠান একেবারে মগডালে। তবে তারকা-অভিনেতা ছাড়াও জনমানসে মিঠুনের একাধিক অবতারে বারে বারে মুগ্ধ হয়েছে মানুষ। সে তাঁর পরোপকারী সত্তা হোক কিংবা সুদক্ষ সংগঠকের। অথবা রাজনীতিবিদ কিংবা সমাজসেবী। প্রতিটি বিভাগেই রীতিমতো ছক্কা হাঁকিয়েছেন তিনি। সঙ্গে জড়িয়েছেন বিতর্কেও!
তবে জানিয়ে রাখা ভালো কখনওই নিজের জন্মদিন ঘটা করে পালন করেননি মিঠুন। জন্মদিন উপলক্ষে রাখেননি কখনও কোনও জাঁকজমক পার্টি। বরাবরই নিভৃতে নিজের পরিবারের সঙ্গে ঘরোয়া পরিবেশে এই দিনটি পালন করে এসেছেন তিনি। বলিউডের সুপারস্টার থাকাকালীনও এ নিয়মের হেরফের হয়নি। মিঠুনকে ঘিরে মানুষের আবেগের পাশাপাশি প্রচলিত রয়েছে একাধিক ঘটনা। অনেকাংশেই সেসব ঘটনা সত্যি। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না পরিচয় হওয়ার আগেই একবার এক সাংবাদিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন মিঠুন! যে সে অপরাধী নয়, রীতিমতো পঞ্জাবের খালিস্তানি জঙ্গিদের থেকে।
সেটা ১৯৮৮ সাল। এক বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে পঞ্জাব গেছিলেন মানস চক্রবর্তী।সঙ্গে ছিলেন একজন ফটোগ্রাফার। উদ্দেশ্যে ছিল 'ফ্লাইং শিখ' মিলখা সিংয়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সেই সংবাদপত্রে লিখবেন। চন্ডীগড়ে দ্রুত কাজ মিটলো। কাজকর্ম শেষ হওয়ার পর দেখা গেল হাতে বাকি রয়েছে এখনও একদিন। শুরু হলো সাতাশির বিশ্বকাপের পর থেকে একপ্রকার 'নিখোঁজ' হয়ে যাওয়া নভজ্যোৎ সিং সিধুর সুলুক সন্ধান। সাক্ষাৎকার নেওয়ার উদ্দেশ্যেই। সিধু তখন থাকতেন ব্যাংক কলোনিতে। পাতিয়ালার বাস গুমটির কাছেই। সে কাজ মিটতে মিটতে সন্ধ্যে। চন্ডীগড় যাওয়ার শেষ বাসে সঙ্গীকে নিয়ে এরপর চেপে বসলেন মানসবাবু। বেশি যাত্রীও ছিল না। বাইরে তখন জাঁকিয়ে বসেছে ফেব্রুয়ারি মাসের শীত। ঘন্টাখানেক পর বাস থেমে গেল হঠাৎ করেই। দু'দিকে ধু ধু মাঠ। একটু পরেই বাসে উঠলো তিন লম্বা চওড়া যুবক।
মাথায় পাগড়ি,মুখ ঢাকা কাপড় এবং হাতে বন্দুক। বাসের মধ্যে ঘোরাফেরা শুরু করল। মনে হলো কাউকে যেন খুঁজছে। যাত্রীরা তখন ভয়ে কাঁটা। এমন সময় মানসবাবুকে দেখে সামনে এসে দাঁড়ালো ওই তিন জঙ্গি। সাংবাদিক গন্ধ পেলেন বিপদের। পরিচয় জিজ্ঞেস করতে বললেন 'বাঙ্গাল' এর সাংবাদিক তিনি। সিধুর সাক্ষাৎকার নিতেই এসেছিলেন। এবার ঘরে ফিরবেন বলেই স্টেশনের দিকে যাচ্ছেন। জঙ্গিদের হাবেভাবে বোঝা গেল কথাটা মনঃপুত হয়নি তাদের। শেষপর্যন্ত উপায় না দেখে মোক্ষম চালটি ছেড়েছিলেন মানসবাবু। জঙ্গিদের উদ্দেশে বলেছিলেন,' আপলোগ মেরে এল্ডার ব্রাদারক পহচান সকতে হো!' ওপার থেকে প্রশ্ন এসেছিল ' কৌন হ্যায় আপকা এল্ডার ব্রাদার?' বাঁচার তাড়নায় গলার সুর না কাঁপিয়ে মানসবাবু বলেছিলেন,' মিঠুন চক্রবর্তী। দেশ কা মশহুর কলাকার।'
জোঁকের মুখে যেন নুন পড়েছিল। মুখে বাঁধা কালো কাপড়ের আড়ালে যেন স্পষ্ট হয়েছিল বিস্ময়। প্রমাণ হিসেবে নিজের পরিচয়পত্র দেখালেন মানসবাবু। তাঁরও পদবী যে চক্রবর্তী! চালাকিটা ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল জঙ্গিরা। আর মিঠুন তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। আসমুদ্রহিমাচল ভারত জুড়ে তাঁর জনপ্রিয়তা। এরপর কিছুক্ষন সাংবাদিকের পাশে বসেই গল্প আড্ডা মারা শুরু করল তারা। হাতের বন্দুক তখন পড়ে রয়েছে বাসের পাটাতনে। নামার আগে করমর্দন থেকে হাসি দুইই বিনিময় তাঁরা করেছিল মানসবাবুর সঙ্গে। স্রেফ বুদ্ধিই নয় সাংবাদিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন মিঠুন! তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার অনেক আগেই।
এর বছর দশেক পরে মানসবাবুর সঙ্গে মিঠুনের প্রথম আলাপ। এরপর সেই আলাপ গড়ায় ঘনিষ্ঠতায়। মিঠুন নিজেও এই ঘটনা জেনে চমৎকৃত হয়েছিলেন। অবাক যে হয়েইছিলেন, তা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপর অনেক আড্ডা,জমায়েতে রঙিন গল্পের আসরে মানসবাবুর কানে কানে এসে তাঁর অনুরোধ থাকত, 'এই ওই ব্যাপারটা ওঁদের একটু শোনা না! আরে ওই যে পঞ্জাবের ব্যাপারটা।' অনুরোধ রাখতেন মানসবাবু। শ্রোতাদের চোখেমুখে বিস্ময় দেখে তখন তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে ছেলেমানুষি আনন্দ করে উপভোগ করতেন মিঠুন।