এই বারের বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন দ্বিধাহীন ভাবে জানিয়েছেন, জলবায়ু সমস্যা ভারতের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই দিকটি মাথায় রেখে তিনি বাজেটে সাতটি বিশেষ পরিকল্পনার কথা বলেছেন, যাতে আগামী দিনে ভারত কম কার্বন উৎপাদনকারী অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হতে পারে।
এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সৌর মডিউল তৈরির জন্য অতিরিক্ত ১৯,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে প্রোডাক্ট সম্পর্কিত ইনসেনটিভ (পিএলআই) এর জন্য। যার ফলে সাধারণ পলিসিলিকনের জায়গায় সৌরচালিত পিভি মডিউলের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে। আশা করা যায়, এর ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৮০ গিগা ওয়াটের সৌরশক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব হবে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বিশেষ গ্রিন (সবুজ) বন্ডের কথা। যার সাহায্যে সরকার এই ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে বাজার থেকে ঋণ নিতে পারবে সবুজ বা জলবায়ু বান্ধব পরিকাঠামো বানানোর জন্য। পাবলিক সেক্টরের যেই সমস্ত প্রকল্প চলছে সেখানে এই বন্ডগুলি কাজে লাগানো যাবে। যার ফলে অর্থনীতিতে কার্বনের প্রভাব কমানো সম্ভব হতে পারে ধাপে ধাপে।
গত বছর ১ নভেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন কনফারেন্সে (সিওপি২৬) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত অজীবাশ্ম শক্তি ক্ষমতায় ক্ষেত্রে ৫০০ গিগাওয়াটের লক্ষ্য মাত্রা ছুঁতে পারবে। অর্থাৎ দেশের সমস্ত কর্মকাণ্ডের জন্য যে শক্তির প্রয়োজন, তার মাত্র ৫০ শতাংশ খনিজ জীবাশ্ম থেকে আসবে। এর অর্থ হল, ২০৩০ সালের মধ্যে ১ বিলিয়ন টন কার্বন নির্গমন কমাতে সক্ষম হবে ভারত। অর্থাৎ দেশীয় অর্থনীতির মাত্র ৪৫ শতাংশ নির্ভর করবে কার্বনের উপর।
২০৭০ সালে ভারত অচিরেই শূন্য কার্বন উৎপাদনকারী অর্থনীতির সুফল পাবে। তবে প্রধানমন্ত্রী এও জানান, এই লক্ষ্যমাত্রা অসম্ভব হবে যদি পৃথিবীর উন্ননয়শীল দেশগুলো জলবায়ুর অর্থনৈতিক বাস্তব মেনে না চলে। ভারতের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, ‘সামনের দিনে উন্নয়নশীল দেশগুলি ১ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নে অগ্রণী হবে বলে ভারতের আশা।’
গত বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন, ভারত ইতিমধ্যেই ১০০ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণ শক্তি ইনস্টল করেছে। এছাড়া তিনি জানান, জি২০ দেশগুলোর মধ্যে ভারত একমাত্র দেশ, যেখানে জলবায়ু লক্ষ্যের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।
‘বলতে দ্বিধা নেই, জলবায়ুর সমস্যা ভারত এবং অন্যান্য দেশের জন্য চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্লাসগোতে সিওপি২৬ কনফারেন্সে ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, এখন আমাদের ভাবনাচিন্তা করে ভবিষ্যতের কথা ভেবে এগোনো প্রয়োজন। এর ফলে একাধিক স্তরে চাকরির সম্ভাবনা তৈরি হবে। এই বাজেট বাস্তবের কথা মাথায় রেখে, অদূর ভবিষ্যতের পাশাপাশি ও দীর্ঘস্থায়ী দিক বিবেচনা করে প্রস্তাব করা হয়েছে।’ জানান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
এই বাজেটে এছাড়াও বলা হয়েছে, কীভাবে বৃত্তাকার অর্থনীতি সামনের দিনে উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ভারসাম্য রেখে যেখানে ১০টি সেক্টরের ক্ষেত্রে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি যা বৈদ্যুতিন বর্জ্য, যানবাহনের জীবন শেষ হওয়া, ব্যবহারিক তৈল বর্জ্য এবং শিল্প থেকে নির্গত ক্ষতিকারক বর্জ্য নিয়ে কাজ করবে। এছাড়া ৫ থেকে ৭ শতাংশ বায়োমাস পেলেট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার হবে। যার ফলে ৩৮ এমএমটি বার্ষিক কার্বন ডাই অক্সাইড কম তৈরি হবে। এর ফলে উত্তর ভারতে খড় পড়ানোর ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।
পুরো কার্যপ্রণালীর ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়িক বিল্ডিং বানানো হবে এনার্জি সার্ভিস কোম্পানি (ইএসসিও) ব্যবসায়িক মডেলে। এর সঙ্গে চারটি পাইলট প্রজেক্ট করা হবে, যেখানে কয়লা থেকে গ্যাস উৎপন্ন হবে এবং বেশ কিছু কেমিক্যাল। এছাড়া প্রকৃতি-বান্ধব কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে উঠে আসা কৃষকদের আর্থিক সাহায্য করা হবে, যাঁরা কৃষি নির্ভর বনায়নের সঙ্গে যুক্ত হবে।
পরিবেশ, জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ভারতের এই কম কার্বন-উৎপাদনকারী অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়াকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
গগন সিধু, ডিরেক্টর, সিইইডব্লিউ সেন্টার ফর এনার্জি ফিন্যান্স (সিইইডব্লিউ - সিইএফ) বলেন, ‘এবারের বাজেটে প্রস্তাব রয়েছে সার্বভৌম গ্রিন বন্ডের। এটি থেকে বোঝা যায়, ভারত জলবায়ু সমস্যা নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন। ভারত ইউরোপের কিছু দেশের মতো এই ধরনের বন্ডের কথা ভেবেছে, যা ঘরোয়া কর্পোরেট গ্রিন বন্ড মার্কেট তৈরি করতে সাহায্য করবে। এখনও পর্যন্ত ভারতীয় কোম্পানির ইস্যু করা গ্রিন বন্ড বিদেশি ঋণ পুঁজি বাজারে যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। তাই এই সার্বভৌম গ্রিন বন্ডের দাম যদি অপেক্ষাকৃত কম হয় অন্যান্য বন্ডের অনুপাতে, তাহলে বেসরকারি বা কর্পোরেট সেক্টর সবুজ নির্ভর লগ্নির ক্ষেত্রে আগ্রহী হবে।’