সোমবার আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। ভাষা শহিদদের মনে করার দিন, মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার অঙ্গীকারের দিন। এর সঙ্গে সব নাগরিকের উপলব্ধিরও দিন যে, কোনও ভাষা ছোট বা বড় নয়, বা ভাষার নিরিখে কোনও বৈষম্য করা যাবে না। এই বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের থিম হল প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক ভাষা শেখা। তাই এই দিনের গুরুত্ব বা ব্যাপ্তি অপরিসীম।
একটু অন্যরকম ভাবলে, বলা যেতেই পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কোনও সংকীর্ণতার কথা বলে না, বরং বহুত্ববাদের কথা বলে। এই বছরে এই বিশেষ দিনের থিম হল প্রযুক্তি ব্যবহারে বহু ভাষা শেখা। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এর অর্থ নতুন ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া।
ভাষা শেখা বা শেখানো পৃথিবীর সহজতম কাজের একটি নয়! গতানুগতিক ভাষাচর্চার বেশ কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছে যা আজকের ইন্টারনেটের যুগে বেমানান অনেকটাই। এর সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট তথা সোশ্যাল মিডিয়ার উত্তরোত্তর প্রভাবে কথ্য ভাষার বিবর্তন চোখে পড়ার মতো। অনেকেই হয়তো ভাববেন যে, মাতৃভাষা তো সবাই এমনিই শেখে, কিন্তু বাস্তব তা নয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পআন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় দিবসে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তিকেরিস্থিতি জটিল যেখানে কেউ এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়েছেন বা বাবা-মায়ের নাগরিকত্ব আলাদা দেশের। ভারতের মতো দেশে সাঁওতালি ভাষা শিখতে গেলে শহরভিত্তিক কলেজ বা ইউনিভার্সিটি যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সাঁওতালি শিশুদের সাঁওতালি ভাষায় পড়াশোনা করার সুযোগই ছিল না। বদলাতে চাওয়া পৃথিবীতে ভাষাচর্চার ভাবভঙ্গী ভেবে দেখার মতো।
কোভিড পরিস্থিতি অনেককেই সুযোগ দিয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে নতুন কিছু শেখার। এই অনেক শেখার মধ্যে নতুন ভাষা শেখার দিকটিও রয়েছে। সেখানে যে সব সময় বিদেশি ভাষা শেখার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, এমন নয়। ভারতের মতো দেশে স্থানীয় ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে ভাষাচর্চা অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছে আমলাতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক স্তরে ভাষার রাজনীতির টানাপোড়েন নিয়ে। দক্ষিণ ভারতের মানুষের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দিল্লির তরফ থেকে অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে। বৈষম্যহীন ভাষানীতি বিশেষ ভাবে প্রয়োজন বর্তমানে। তবে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেই বিষয়টি বারবার উঠে আসে, তা হল যে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ সমাজে কার কার কাছে রয়েছে। ভারতের মতো উন্নতিশীল দেশে যেমন ইংরেজি শেখানোর ক্ষেত্রে গোড়ায় গলদ রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা দোটানায় থাকেন যে ব্যকরণ নিয়ে এগোবেন শুরুতে, নাকি ইংরেজিতে কথা বলতে পারে কি না— সেদিকে নজর দেবে।
ভাষার জনপ্রিয়তার মাপকাঠির দিকটি খুব সহজ সরল। যে ভাষায় যত বেশি মানুষ কথা বলেন, তত তার জনপ্রিয়তার দিকটি টের পাওয়া যায়। তবে ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামিও একটি সমস্যা, যা অনেক সময়েই চোখ এড়িয়ে যাওয়া হয়। বিদেশি অনেক মানুষ জানিয়েছেন, বাংলা ভাষায় লেখা রপ্ত করতে গিয়ে অনেকেই যুক্তাক্ষর নিয়ে হিমশিম খেয়েছেন। উচ্চারণের সময় অনেকেই বলেছেন যদি 'শ' , 'স' , 'ষ' না থেকে যে কোনও একটি থাকত। তবে বর্তমান সময় অন্য রকম, কিছুটা উলাটপুরানও। মাতৃভাষা শেখানোর সুযোগ সুবিধা থাকলেও ইংরেজি শেখার দিকে বিশেষ আগ্রহ। এছাড়া স্থানীয় ভাষা নিয়ে প্রথাগত শিক্ষায় অগ্রণী হলে কিছু অভিভাবকদের তরফ থেকেও আপত্তি থাকে। পাশ্চাত্যের ভাষাচর্চা অনেকটাই এগিয়েছে, অনুবাদ সাহিত্য অনেকটাই সরকারি ও বেসরকারি দাক্ষিণ্য পেয়েছে। তাই সমস্যাটা প্রযুক্তি নয়, অনেক সময়েই তাগিদের বা প্রচেষ্টার। এর সবচেয়ে বড় ফলশ্রুতি হল বানান ভুলের সমাহার। উচ্চারণের ক্ষেত্রেও গাফিলতি ধরা পড়েছে তৃণমূল স্তরে। তাই এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ হোন যে সকলে নিজের সুবিধামতো নতুন ভাষা শিখে বৃহত্তর স্বার্থে নিজের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নতি করবেন সামাজিকের নিরিখে।