চন্দ্রযান ২-র 'ব্যর্থতা'-র হাত ধরেই চন্দ্রযান ৩-র সাফল্যের বীজ বুনছে ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা ইসরো (ইন্ডিয়ান স্পেস অ্যান্ড রিসার্চ অর্গানাইজেশন)। চার বছর আগের দ্বিতীয় চন্দ্রযান মিশনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চন্দ্রযান ৩-তে একাধিক পরিবর্তন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইসরোর চেয়ারম্যন এস সোমনাথ জানিয়েছেন, চন্দ্রযান ২-তে কী ত্রুটি হয়েছিল, তা খতিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। সেই ত্রুটির ভিত্তিতে চন্দ্রযান-৩ নিয়ে এগিয়েছে ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা। পাশাপাশি আরও কী কী ত্রুটি হতে পারে, তাও বিবেচনা করা হয়েছে। যাতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ইসরোর সদর দফতর-সহ পুরো ভারতের চোখে স্বপ্নভঙ্গের জল এসেছিল, সেটা ২০২৩ সালের ২৩ বা ২৪ অগস্ট আনন্দাশ্রুতে পরিণত হতে পারে। সবমিলিয়ে চন্দ্রযান ২-র সঙ্গে চন্দ্রযান ৩-র কী কী পার্থক্য আছে, তা দেখে নিন -
মূল মিশনের ব্লু-প্রিন্ট পরিবর্তন
চন্দ্রযান-৩ মিশনের মূল পদ্ধতির পরিবর্তন করা হয়েছে। ভারতীয় মহাকাশ সংস্থার চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, কীভাবে সাফল্য পাওয়া যাবে, তার ভিত্তিতে দ্বিতীয় চন্দ্রযান মিশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এবার ঠিক উলটো পদ্ধতিতে হেঁটেছে ইসরো। কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে, সেই বিষয়গুলি অনুমান করে তৃতীয় চন্দ্রযানের মিশনের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেইমতো যদি মিশন এগিয়ে না যায়, তাহলে কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে, কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবে, মিশন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তা নিয়ে আগেভাগেই পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছে ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা।
ইসরোর চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমরা এবার যেটা করেছি, সেটা হল যে কী কী বিষয় পরিকল্পনামাফিক না ঘটতে পারে, সেটার ভিত্তিতে ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করেছি। তাই চন্দ্রযান-২ মিশনে যে সাকসেস-বেসড পদ্ধতির (অর্থাৎ কীভাবে সাফল্য পাওয়া যাবে, সেটার ভিত্তিতে মিশনের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হয়েছিল) ব্যবহার করা হয়েছিল, এবার ফেলিয়োর-বেসড প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদি আমাদের পরিকল্পনা সফল না হয়, তারপরও কীভাবে আমরা নিজেদের মিশন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব, সেই পথেই আমরা এগিয়েছি।’
তিনি আরও বলেছেন, 'আমরা বিভিন্নরকম ত্রুটি খতিয়ে দেখেছি - সেনসরের ত্রুটি, ইঞ্জিনের গোলযোগ, অ্যালগোরিদমের গোলমাল, হিসাবে ভুল। তাই নির্দিষ্ট গতিতে অবতরণের ক্ষেত্রে যা যা ত্রুটি হতে পারে, তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। তাই বিভিন্ন ত্রুটির বিষয়গুলি হিসাব করে চন্দ্রযান ৩-র প্রোগ্রামে যুক্ত করে দিয়েছে ইসরো।'
ল্যান্ডিংয়ের জায়গা আরও বড় করা হয়েছে
এবার চাঁদে অবতরণের জন্য যে জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটার পরিধি আগেরবারের থেকে বেশি রাখা হয়েছে। গতবার চাঁদে অবতরণের জন্য ল্যান্ডার 'বিক্রম'-র কাছে মাত্র ৫০০ মিটার*৫০০ মিটার জায়গা ছিল। এবার সেটা বাড়িয়ে ৪ কিলোমিটার*২.৪ কিলোমিটার করা হয়েছে।
আরও মজবুত হচ্ছে ল্যান্ডারের ‘পা’
চাঁদে অবতরণের জন্য ল্যান্ডারের 'পা' আরও মজবুত করা হয়েছে। যাতে অবতরণের সময় দ্বিতীয় চন্দ্রযানের থেকে আরও বেশি বেগ সইতে পারে ল্যান্ডার। বিষয়টি নিয়ে ইসরোর চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, এবার ল্যান্ডারের অনেক উন্নতি করা হয়েছে। ল্যান্ডিংয়ের বেগ প্রতি সেকেন্ডে দু'মিটার থেকে বাড়িয়ে তিন মিটার করা হয়েছে। অর্থাৎ বেশি বেগে অবতরণের সময়ও ল্যান্ডারের 'পা' ভাঙবে না। ইসরোর অপর এক বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, প্রতি সেকেন্ডে দু'মিটার বেগে ল্যান্ডারের অবতরণ করার বিষয়টি সুরক্ষিত। কিন্তু পরিস্থিতি যদি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নাও থাকে, তাহলে গতিবেগ বাড়িয়ে ল্যান্ডার অবতরণ করানো যেতে পারবে।
ল্যান্ডারে বেশি জ্বালানি রাখা হয়েছে
তৃতীয় চন্দ্রযান মিশনের ল্যান্ডারে বাড়তি জ্বালানি থাকছে। যাতে কোনওরকম সমস্যা হলে বেশিক্ষণ ঘুরপাক করে উপযুক্ত সময় চাঁদের মাটিতে নামতে পারে ল্যান্ডার। অথবা প্রয়োজনে বিকল্প কোনও জায়গায় নামতে পারে। সেইসঙ্গে নয়া সেনসরও ব্যবহার করা হয়েছে।
কমেছে ইঞ্জিনের সংখ্যা, উন্নত হয়েছে সফটওয়্যার
চন্দ্রযান ২-তে মোট পাঁচটি ইঞ্জিন ছিল। চন্দ্রযান ৩-তে ইঞ্জিনের সংখ্যা কমিয়ে চার করা হয়েছে। ইসরোর চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, আগেরবার ল্যান্ডারের যা ওজন ছিল, তাতে পাঁচটি ইঞ্জিন ঠিক ছিল। কিন্তু এবার ল্যান্ডারের ওজন প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম বেড়েছে। সেই পরিস্থিতিতে ল্যান্ডিংয়ের সময় ন্যূনতম দুটি ইঞ্জিন চালু রাখতে হবে। একটি ইঞ্জিনে চাঁদে অবতরণ করতে পারবে না ল্যান্ডার। তাই সেন্ট্রাল ইঞ্জিন (পঞ্চম ইঞ্জিন, যা শেষমুহূর্তে চন্দ্রযান ২-তে যুক্ত করা হয়েছিল) বাদ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে ইঞ্জিনে কোনও গোলযোগ হলে, সেনসর কাজ না করলে যাতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়, সেজন্য সফটওয়্যার আরও উন্নত করা হয়ছে।
অবতরণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় চন্দ্রযান মিশনের মদত
খাতায়কলমে সাফল্য পায়নি চন্দ্রযান-২। তবে তৃতীয় চন্দ্রযান মিশনের সাফল্য পেলে তাতে চন্দ্রযান ২-র বড় অবদান থাকবে। কারণ চন্দ্রযান ৩-র ল্যান্ডার যখন চাঁদের মাটিতে অবতরণ করবে, তখন শুধুমাত্র নিজের তোলা ছবির উপর নির্ভর করবে না। ঠিকঠাক জায়গায় অবতরণ করছে কিনা, তা বোঝার জন্য চন্দ্রযান ২-র তোলা ছবি ব্যবহার করবে চন্দ্রযান ৩-র ল্যান্ডার।
বাড়তি সোলার প্যানেল
এবার ল্যান্ডারে আরও বেশি সংখ্যক সোলার প্যানেল আছে। ইসরোর প্রধান জানিয়েছেন, যেভাবেই ল্যান্ডার চাঁদের মাটিতে অবতরণ করুক না কেন, তা আরও বেশি শক্তি তৈরি করতে পারবে।