লকডাউনের জেরে মানুষ নিজের পছন্দের রেস্তোরাঁ, ক্যাফে বা পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের মায়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। তবে এই সময়ই অনেকেই নিজের অন্দরের লুকিয়ে থাকা বাবুর্চিকে জাগিয়ে তুলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ঝড় তুলেছেন। যে খাবারগুলি বাড়িতে তৈরির কথা আমরা কেউই প্রায় ভাবতেই পারতাম না, সে সবই এক এক করে গেরস্থালির হেঁশেল আলো করেছে। লকডাউনে রান্না একপ্রকার ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। হেন কোনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ছিল না, যেখানে বাড়িতে তৈরি খাবার-দাবারের ছবি দেখতে পাওয়া যায়নি। লকডাউনের সময় জনপ্রিয় থুড়ি ভাইরাল হয়েছিল, এমন কয়েকটি খাবারের বিষয় এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। বছর শেষে না-হয় ফের একবার লকডাউনের ভাইরাল খাবার-দাবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
১. ডালগোনা কফি- ইন্টারনেট মাতাতে খুব একটা সময় নেয়নি এই পশ্চিমি কফিটি। নানান কায়দায়, নানান ভাবে ইন্টারনেটে ডালগোনা নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। অনেকে অবশ্য দেশী ফ্যাটানো কফি হিসেবেই বিচার করেছে ডালগোনাকে। সময় সাপেক্ষ এই কফি তৈরির প্রক্রিয়া অনেকে অপছন্দও করেছেন। তাই বলে ইনস্টাগ্রাম হোক বা ফেসবুক, ডালগোনার ছবির রোশনাই ম্লান হয়নি। এ ক্ষেত্রে কফির স্বাদ নিয়ে কারও মাথাব্যথা না-থাকলেও, ছবি পোস্টে ভাটা পড়েনি।
২. ফুচকা- কলকাতার ফুচকা, দিল্লির পানিপুরি, পঞ্জাবের গোলগাপ্পা— নাম যা-ই হোক না কেন, ১৯-২০ পার্থক্যে ফুচকা তৈরির পদ্ধতিতে তেমন কোনও ফারাক নেই। আলুমাখা হোক বা কাবুলিছোলা, তেঁতুল জল হোক বা ধনে-পুদিনায় লেবুর টক দেওয়া জল, চেখে দেখার লোভ সামলাতে পারেনি কেউ। ভিন রাজ্যে ঘুরতে গিয়ে ফুচকা চাখেননি, এমন লোকের সংখ্যা কমই বলা যায়। কলাকাতর অলি-গলিতে স্কুলছুট, অফিসছুট, ৮-৮০ সকলেরেই আনাগোনা লেগে থাকত ফুচকাআলা কাকু-দাদুর স্টলে। কিন্তু লকডাউনের কয়েক মাস তো তার কোনও অবকাশই ছিল না। অগত্যা বাড়ির হেঁশেল জাঁকিয়ে বসলেন ফুচকারানি। কেউ কেউ দোকান থেকে ফুচকা কিনে এনে বাড়িতেই এর জল ও আলুমাখা তৈরি করে নিজের স্বাদগ্রন্থি চরিতার্থ করেছেন, আবার কেউ কেউ তো ফুচকা পর্যন্ত বাড়িতে বানিয়ে ফেলেছেন। শুধু বানিয়ে খেলেই কী হল, ইনস্টাগ্রাম, ফেবু-তেও তো নিজের বাবুর্চিপনা জাহির করতে হবে। তাই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও পদার্পণ ফুচকার। লকডাউন পরবর্তী সময় আমরা প্রত্যেকে এভাবেই চেষ্টা করেছি চাপমুক্ত হওয়ার।
৩. পাউরুটি- মনে পড়ে স্কুল পিকনিকে পাউরুটির অপরিহার্যতা? শুধু স্কুল পিকনিকই কেন, বাড়িতেও পাউরুটি-অমলেট অতিসাধারণ একটি প্রাতঃরাশ। বাড়ি না-হোক চায়ের দোকানেও সকালের দিকে ডিম-পাউরুটি বিক্রি হয় রমরমিয়ে। লকডাউনে পাউরুটি বাবাজীবনও নতুন সাজে নতুন রূপে হেঁসেল থেকে বাহির হয়েছেন। সাধারণত নানান ধরণের পাউরুটি আমরা দোকান বেকারি থেকেই কিনে আনি। লকডাউনের সময় পাউরুটি, দুধ— অপরিহার্য খাদ্য সামগ্রী হিসেবে দোকানে পাওয়া গেলেও, বাড়িতে তৈরির ইচ্ছা ত্যাগ করতে পারিনি আমরা। সময় নষ্ট না-করে ইনস্টাগ্রামে ট্রেন্ড করতে শুরু করে #homemadebread। এমন অনেকেই আছে, যাঁরা লকডাউনের আগে পর্যন্ত রান্নাঘরের ত্রিসামানায় আসতেন না, তাঁরাও এ সময় রান্নায় নিজের হাত পাকাতে দ্বিধা করেননি। পাউরুটির মতো এমন একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য সামগ্রী বাড়িতে তৈরির ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্তিও বোধ করেছেন অনেকে। চিরাচরিত সাদা পাউরুটির পাশাপাশি বানান ব্রেড লকডাউনের সময় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
৪. মোমো- এই পাহাড়ি খাবারটির প্রতি আমারা বহু যুগ ধরে আসক্ত। এই আসক্তি উত্তোরত্তোর বৃদ্ধিই পাচ্ছে। বর্তমানে বড় বড় ফুডকোর্ট, রেস্তোরাঁর পাশাপাশি রাস্তার ধারের ছোট্ট একটি গুমটি থেকেও মোমো বিক্রি হচ্ছে রমরমিয়ে। কোভিড হানার কারণে দোকানপাট বন্ধ হওয়ায় বাড়িতেই তৈরি হয়েছে মোমো। আর এর সাক্ষী থেকেছে সোশ্যাল মিডিয়া। ইনস্টাগ্রাম ও ট্যুইটারে বাড়িতে মোমো রাঁধার চ্যালেঞ্জের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল।
৫. সিঙাড়া- বাড়িতে অতিথি সমাগম হলে মিষ্টির প্লেটে বুক উঁচিয়ে, জাঁকিয়ে বসত এই তেকোণা নোনতা খাবারটি। শুধু তাই নয়, বিকেলের চায়ের সঙ্গে সিঙাড়াও ছিল আম খানাপিনা। কিন্তু লকডাউনের ফলে ময়রাদের দোকানের ঝাপ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে সিঙাড়ার আনাগোনাও হল বন্ধ। কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরেই তৈরি হতে লাগল সিঙাড়া। অবাঙালি, মারোয়াড়ি পরিবারে সামোসা তৈরি সাধারণ ঘটনা হলেও, বাঙালিদের বাড়িতে এটি হত না-বললেই চলে। সেই বাঙালি বাড়ির রান্নাঘর থেকেই লকডাউনের সময় ভেঁসে এল সিঙাড়ার সুবাস। মিষ্টির দোকান বন্ধ হলেও সিঙাড়ার প্রতি ভালোবাসা তো আর ত্যাগ করা যায় না। ডুবো তেলে ছেঁকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা সিঙাড়ার ছবি ভিড় করল ইনস্টাগ্রাম-সহ নানান সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে।
৬. চকোলেট কেক- মে মাসে গুগলে প্রথম ১০টি সার্চড রেসিপির মধ্যে নাম লিখিয়েছে চকোলেট কেক। দোকানে বা বেকারিতে পাউরুটি পাওয়া গেলেও, পাওয়া যেত না এটি। লকডাউন তো কী হয়েছে, তাই বলে জন্মদিনে একটা কেক থাকবে না! তা তো এক্কেবারেই হতে দেওয়া যায় না। তাই তো নেট ঘেটে চকোলেট কেক বানানোর প্রক্রিয়া জেনে বাড়িতেই তৈরি করা হয়েছে। এত খাটাখাটনির পর আত্মসন্তুষ্টি ও আনন্দ জাহির করে বাড়িতে তৈরি কেকের ছবি পোস্ট করেননি, এমন ক’জন আছেন?