বাংলা নিউজ > ঘরে বাইরে > ডাইনি অপবাদে হত্যা রোধে বিশেষ অবদান, পদ্মশ্রী পেলেন অসম ও ঝাড়খণ্ডের দুই বৃদ্ধা

ডাইনি অপবাদে হত্যা রোধে বিশেষ অবদান, পদ্মশ্রী পেলেন অসম ও ঝাড়খণ্ডের দুই বৃদ্ধা

ডাইনি সন্দেহে হত্যা ও অত্যাচার রোধে বিশেষ অবদানের কারণে এ বছর পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হলেন ঝাড়খণ্ডের ছুটনি মাহাত (বাঁয়ে) এবং অসমের বিরুবালা রাভা।

দুই সমাজকর্মীর সামগ্রিক চেষ্টায় উদ্ধার হয়েছেন ৩২৫ জন হতভাগ্য নারী-পুরুষ।

ডাইনি সন্দেহে হত্যা ও অত্যাচার রোধে বিশেষ অবদানের কারণে এ বছর পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হলেন অসমের বিরুবালা রাভা (৭২) এবং ঝাড়খণ্ডের ছুটনি মাহাত (৬২)। তাঁদের সামগ্রিক চেষ্টায় উদ্ধার হয়েছেন ৩২৫ জন হতভাগ্য নারী-পুরুষ।

এক দশক আগেও অসমে ডাইনি সন্দেহে প্রতি বছর গড়ে ১২-১৫ জনকে খুন করা হত। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই সংখ্যা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে, যার অন্যতম প্রধান কারণ বিরুবালা রাভা। সোমবার তাঁর নাম পদ্মশ্রী সম্মান প্রাপকদের তালিকায় স্থান পাওয়ায় খুশি প্রবীণা। সম্মান প্রাপ্তির খবরে বিরুবালা বলেন, ‘এই সম্মান পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত। গত কয়েক বছরে যে কাজ করে চলেছি, তার জন্য অনেক সংগ্রাম এবং জীবনের ঝুঁকি পোহাতে হয়েছে। দুঃসময়ে যাঁরা সাহায্য করেছেন, এই স্বীকৃতি তাঁদেরই আশির্বাদে এসেছে।’

বিরুবালার জন্ম ১৯৪৯ সালে অসম-মেঘালয় সীমান্তের এক গ্রামে। তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন এবং খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে প্রতিবেশীদের মৃত্যুর জন্য তাঁকে ডাইনি বলে দোষারোপ করেন গ্রামবাসী। সমাজে তাঁকে একঘরে করার সঙ্গে সঙ্গে মোটা জরিমানা চাপায় স্থানীয় পঞ্চায়েত। 

অসম সরকারের নথি বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মোট ১০৭ জনকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়। গত অক্টোবর মাসেও অসমের কারবি আংলং জেলায় বছর পঞ্চাশের এক বিধবা এবং ২৮ বছর বয়েসি মানসিক বিপর্যস্ত এক যুবককে ডাইনি সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে খুন করা হয়।

ডাইনি অপবাদ মাথায় নিয়েও কিন্তু সাহস হারাননি বিরুবালা মাহাত। উলটে সমাজের এই অন্যায় মেনে না নিয়ে তার বিরুদ্ধে তিনি জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং অসহায় নারী-পুরুষদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। 

বিরুবালার ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাট্যবীর দাস জানিয়েছেন, ‘তিনি একা চেষ্টা করলেও ২০১২ সালে বিরুবালা মিশন গঠনের আগে পর্যন্ত বিশেষ ফল মেলেনি। বর্তমানে গোটা অসমে আমাদের কাছে প্রায় ৬০০ সদস্য রয়েছেন যাঁরা এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০০ মানুষকে বাঁচাতে পেরেছি।’

আর পদ্মশ্রী পাওয়ার পরে স্বয়ং বিরুবালা বলেন, ‘আমার জীবন ও কাজ অন্যদের জন্য উৎসর্গীকৃত। দীর্ঘ সংঘর্ষপূর্ণ হলেও তৃপ্তি লাভ না করে যে অভিযানে নেমেছি, তা শেষ না করে বিশ্রাম নেব না।’ 

বিরুবালার মতোই ডাইনি সন্দেহভাজনের মিথ্যা অভিযোগ ও প্রাণের ঝুঁকির মধ্যে থেকেও অসহায় মহিলাদের রক্ষা করতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা ছুটনি মাহাত। ২৫ বছর আগে তাঁকেও ডাইনি অপবাদ দিয়ে ধর্ষণ ও খুনের চেষ্টা করে গ্রামবাসীদের একাংশ। সেই মারাত্মক ঝুঁকি মাথায় নিয়েও অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না ছুটনি। 

তৃতীয় শ্রেণির বিদ্যাসম্বল করেই ১৯৭৮ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে সংসার জীবনে প্রবেশ করতে হয় জনজাতি অধ্যুষিত এলাকার এই বাসিন্দাকে। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে প্রথমে সম্পর্ক ভালো থাকলেও ১৯৯৫ সালে প্রতিবেশী একটি মেয়ে অসুস্থ হওয়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে কালোজাদু চর্চার অভিযোগ তোলেন কয়েকজন গ্রামবাসী। বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁকে মারধরের পরে ধর্ষণের চেষ্টাও করা হয়। তাতে বিফল হলে খুনের হুমকি দেওয়া শুরু হয়। 

ছুটনির অভিযোগ, বিপাকে পড়েস্থানীয় বিধায়কের দ্বারস্থ হলেও সুরাহা হয়নি। থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন ওসি, দাবি ছুটনির। সেই দুঃসময়ে তাঁর পাশে দাঁড়ান সেরিয়াকেলার এসডিও নিধি খারে, যিনি অসহায় বধূকে জামশেদপুরের এক বেসরকারি অ-লাভজনক সংস্থার আইনি সহায়তা সেল-এ পরামর্শ নিতে পাঠান। সেখানে গিয়েই জীবন সম্পর্কে ধারনা পালটে যায় ছুটনির। 

পরে নিজেই ডাইনি সন্দেহে নিগৃহীতাদের জন্য একটি উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন তিনি। সেই কাজে তাঁকে সাহায্য করেন সংস্থার সভাপতি প্রেমচন্দ, পশ্চিম সিংভূম জেলার ডেপুটিকমিশনার অমিত খারে এবং রাঁচির এক এনজিও। এখনও পর্যন্ত ১২৫ নির্যাতিতা মহিলাকে উদ্ধার করে নতুন জীবন দিয়েছে ছুটনি মাহাতর সংস্থা।

ছুটনির এই জীবন সংগ্রাম নিয়ে ১৯৯৬ সালে ‘আখির কব তক’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয় এবং ২০১৪ সালে ‘কালা সচ’ নামে একটি বাণিজ্যিক হিন্দি ছবিও তৈরি হয়।

এ বছরের মোট ১০২জন পদ্মশ্রী প্রাপকের তালিকায় স্থান হয়েছে ছুটনি মাহাতর। সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর নিরন্তর লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।

বন্ধ করুন