কিংবদন্তি শিল্পী উস্তাদ রাশিদ খান আর নেই। তবে তাঁর স্মৃতিরা থেকে গিয়েছে। থেকে গিয়েছে তাঁর কণ্ঠ, গান। গত ৯ জানুয়ারি, জীবনযুদ্ধে ইতি টেনে অমৃতলোকে পাড়ি দিয়েছেন ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি নিজে যেমন সঙ্গীতের সাধক ছিলেন, তেমনই আজীবন সঙ্গীত সাধনা শিখেয়েছেন হাজারো ছাত্রছাত্রীকে। উস্তাদ রাশিদ খানের অকাল মৃত্যুতে তাই শোকাতুর তাঁর গুণমুগ্ধরা।
উস্তাদকে যাঁরা খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে, তাঁদের জীবনে থেকে গিয়েছে রাশিদ খানের বহু স্মৃতি। এমনই বহু অজানা কথা স্মৃতি ফেসবুকের পাতায় ভাগ করে নিয়েছেন আরও এক খ্যতনামা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তী। বর্তমানে তিনি অবশ্য থাকেন লন্ডনে। UK-তে ‘কলাকার আর্টস’-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। চন্দ্রা, যিনি রাশিদ খানকে খুব ছোট্ট থেকেই চিনতেন। চন্দ্রা চক্রবর্তীর বয়স যখন ১২, তখন রাশিদ খানের বয়স ১৭। উস্তাদকে তিনি রাশিদ দা বলেই ডাকতেন।
চন্দ্রা চক্রবর্তী তাঁর দীর্ঘ পোস্টে লিখেছেন, ‘একজন শিল্পী পন্ডিত বা ওস্তাদ হয়ে যাবার পর তাঁর পাশে আরো অনেক পন্ডিত বা ওস্তাদ থাকেন, থাকেন আরো কত গুণমুগ্ধ মানুষ। কিন্তু সেই শিল্পীর পন্ডিত বা ওস্তাদ হয়ে ওঠার আগের গল্পগুলো হয়তো সবসময় বলা হয়ে ওঠেনা। ওস্তাদ রাশিদ খানকে জানি শৈশব থেকে, আমার তখন ১২ বছর বয়স আর উনি ১৭ , কলকাতায় সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমিতে এক সঙ্গেই বড় হয়েছি। কালে কালে তিনি পরিণত হয়েছেন এযুগের মহত্তম সঙ্গীত প্রতিভায়, কিন্তু আমার কাছে আগের মতই দাদা….’
চন্দ্রা চক্রবর্তী আরও লিখেছেন, ‘সালটা মনে হয় ১৯৮৮, একাডেমীতে scholar দের gradation test চলছে। ওই সময় scholar বলতে সব চেয়ে ছোট আমি আর জয়িতা (জয়িতা পান্ডা), ছেলেদের মধ্যে ছোট রাশিদ দা আর জয়নুল (জয়নুল আবেদীন)। আর বড়ো scholar রা ছিল শুভ্রাদি (বিদুষী শুভ্রা গুহ), শাস্বতীদি ( শাস্বতী ব্যানার্জী), রুবিদি (রুবি মল্লিক), ডালিয়াদি (বিদুষী ডালিয়া রাহুত), বিজয়াদি (বিজয়া যাদব) আর সন্দীপদা ( সন্দীপ ঘোষ)। ঐদিন টেস্ট ছিল শুভ্রাদি আর রাশিদ দার। দুপুরে গুরুজী গুরুমা আর আমি লাঞ্চ করছি, এমন সময় SRA র studio থেকে আসলাম ফোন করে জানালো বিজয় আঙ্কেল (পণ্ডিত বিজয় কিছলু) আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। খাওয়া সেরে আলদীনে আঙ্কেলের অফিসে গেলাম। যাবার পর জানা গেলো শুভ্রাদির বাড়িতে একটা অঘটন ঘটেছে, তাই ওই দিন শুভ্রাদি গাইতে পারবেনা, আমাকে গাইতে হবে।’
চন্দ্রা চক্রবর্তী লিখছেন, সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে তাঁর Gradation test দেওয়ার কথা। যেসময় রাশিদ খানের আগে গান গাইতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি লিখেছেন, 'Gradation test বড্ডো ভয়ের ব্যাপার ছিল, কারণ ওই সময় আমাদের expert committee র মেম্বার, যারা সামনে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে নির্বিকার মুখে আমাদের পরীক্ষা নিতেন তারা ছিলেন এক একজন মহারথী- পণ্ডিত বিজয় কিছলু, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পণ্ডিত অজয় সিনহা রায়, পণ্ডিত ভি জি যোগ, পণ্ডিত অমিয় রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়, পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গুরুজী পণ্ডিত এ কানন, বিদুষী মালবিকা কানন, বিদুষী দীপালি নাগ, বিদুষী গিরিজা দেবী। ওই দিন আবার উস্তাদ আল্লারাখা খান সাহেব আর জাকির ভাইও কি একটা কারণে কলকাতায় ছিলেন তাই ওনাদেরও থাকার কথা ছিল। Expert Committee র কাজ ছিল আমাদের গান শুনে ছোট ছোট খাতায় ভুল ত্রুটি গুলো নোট করা। Test শেষ হবার পরের সপ্তাহে আমাদের এক এক করে ডেকে আমাদের গাওয়া গানটা চালিয়ে ভুল ত্রুটি গুলো ধরিয়ে দেওয়া হতো, সে আর এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার !
এমন সব লোকজনের সামনে বসে test দিতে গেলে কয়েকশো বার হার্টফেল হয়ে যায় । আমারও আজ তুমকোহি গানা পড়েগা রাশিদ সে পেহলে, শুনে সেই অবস্থা। হাঁপাতে হাঁপাতে গুরুমার কাছে গেলাম, গুরুমা সব শুনে বললেন সারা সকাল তো পুড়িয়াধানেশ্রী শেখালাম, ওটাই উগরে দিস। দু দিন পরে গাওয়া আর আজ গাওয়া তো একই ব্যাপার । বিদুষী মালবিকা কাননের কাছে যেটা একই ব্যাপার, একটা ১৫ বছরের মেয়ের কাছে তো তা নয়, তার পর আবার রাশিদ দা'র আগে গাওয়া। রাশিদ দা ততদিনে উস্তাদ রাশিদ খান না হলেও যথেষ্ট নাম করেছে, ওর গান কোথাও হবে শুনলে তিল ধরণের জায়গা থাকেনা। যাই হোক, বুকের মধ্যে প্রচন্ড ভয় নিয়ে সন্ধে ৬টায় স্টেজে উঠলাম। গান শেষ হবার পর যখন আমি স্টেজে থেকে নামছি, তখন রাশিদ দা উঠছে। হল কানায় কানায় ভর্তি। স্টেজে ওঠার আগে দাদা আমার কানে কানে বললো দারুন গেয়েছিস, এবার আমি বুড়ো গুলোকে শুনিয়ে আসি। হাসি চেপে আমি গুরুমার পেছনে গিয়ে বসলাম।'
তাঁর কথায়, ‘রাশিদ দাকে কোনো দিন গানবাজনা নিয়ে politics করতে দেখিনি, তাই হয়তো বেশিদিন এই জগতে থাকতে চাইলো না ....’
এখানে শেষ নয়, চন্দ্রা চক্রবর্তীর পোস্টে উঠে এসেছে রাশিদ খানেক কাছে 'মারুবেহাগ' শোনার কথা। আবেগতাড়িত হয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আশা করছি খুব শিগগিরি তোমার মারুবেহাগ শুনবো দাদা, একেবারে সামনে বসে.…ভালো থাকো ...’।