১৯৮২, মুক্তি পেয়েছিল কিংবদন্তি পরিচালক মৃণাল সেনের ছবি ‘খারিজ’। ছবিতে মৃত্যু হয়েছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক পরিচারকের। সেই মৃত্যুর পর থেকে কেটে গিয়েছে বহু বছর। তবে উত্তর কলকাতার সেন পরিবার এখনও বিবেক দংশন থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সেই তিক্ত স্মৃতি বুকে নিয়েই আসছে পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি 'পালান'। পরিচালক মৃণাল সেনের জন্ম শতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই 'খারিজ'-এর চরিত্রগুলিকে আরও একবার পর্দায় ফিরিয়ে আনছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। আর সেই ‘খারিজ’ থেকে 'পালান'-এ ফিরে আসা নিয়েই হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে কথা বললেন পর্দার মমতা সেন ওরফে অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্কর। কথায় কথায় উঠে এল আরও নানান প্রসঙ্গ…
বাড়িতে ছিলেন না, ফোন করতে বলেছিলেন রাত ১১টায়। সেই মতোই ফোন করলাম। ছোট্ট নাতিকে সময় দিতে দিতেই মন দিয়ে কথা শুনলেন, আর নানান কথা বললেন…
'খারিজ'-এর চরিত্রগুলিই তো ‘পালান’-এ আবারও ফিরছে?
মমতা শঙ্কর: হ্যাঁ, এক্কেবারেই তাই। 'খারিজ'-এর সেই মমতা সেন মানে আমি, সেই চরিত্র হয়েই আবারও এখানে আছি। এছাড়াও অঞ্জন সেন, শ্রীলা, সেই চরিত্রগুলিই ফিরছে।
'খারিজ' থেকে ‘পালান’, মমতা সেন কতটা বদলেছেন?
মমতা শঙ্কর: বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতাও বেড়েছে, তবে মানুষটা একই আছে। (হেসে)
'খারিজ'-এ একটা মৃত্য়ু হয়েছিল, 'পালান'-এর ট্রেলারেও একটা মৃত্য়ু দেখা যাচ্ছে…
মমতা শঙ্কর: গল্পটা তো বলা যাবে না, ঘটনাক্রম দেখার জন্য ছবিটা দেখতে হবে (হেসে)। তবে 'খারিজ'-এ একটা অন্যায় হয়েছিল, আমাদের তরফে একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। আর এখন দেখা যাবে সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই কীভাবে সাম্প্রতিক ঘটনায় রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। এটুকুই বলতে পারি।
'পালান'-এর শ্যুটিংয়ের সময় 'খারিজ'-এ মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজের স্মৃতি নিশ্চয়ই মনে ফিরে আসছিল?
মমতা শঙ্কর: সে তো অনেক স্মৃতি আছে, বলতে শুরু হলে শেষ হবে না। (আবেগতাড়িত হয়ে) খারিজের আগে 'এক দিন প্রতিদিন'-এ শ্রীলার চরিত্রটিতে আমার কাজ করার কথা ছিল। তখন আমার বড় ছেলের মাত্র ১৭ দিন বয়স। আমি নার্সিংহোম থেকে সবে ফিরেছি। ১৪ দিনের শিশুকে ছেড়ে অতক্ষণ বাইরে থাকাটা খুব মুশকিল। এদিকে মৃণালদা যখন আমায় কাজের কথা বললেন, ওঁকে না বলাটা আমার পক্ষে খুব মুশকিল ছিল। তখন বললাম, মৃণালদা কোনও ছোট চরিত্র থাকলে সেটা আমায় দিন। বললেন, একটা চরিত্র আছে, ছবিটা তাঁকে নিয়েই, তবে চরিত্রটা ছোট। তখন আমি বললাম, তাহলে ওটাই আমি করব। আর তারপর যখন 'খারিজ' করলাম, মৃণালদা আমায় বললেন, ‘তুমি এখন অনেক বেশি মন দিয়ে কাজ করছো। কারণ, 'একদিন প্রতিদিন’-এর সময় তো আমি মন দিয়ে কাজই করতে পারিনি। সারাক্ষণই মনে হত কখন বাড়ি যাব! তখন এক-দুই দিনেই শ্যুটিং শেষ করতে হয়েছিল। তখন কিছুতেই অভিনয়ে মন দিতে পারছিলাম না।
আরও একটা কথা খুব মনে পড়ছে। 'খারিজ' দৃশ্যে ছিল, ছেলেটি মারা গিয়েছিল, পালানের বাবা এসেছিল মাইনে নিতে। আর আমি প্রশ্ন করছিলাম, 'পালান'-এর বাবাকে আমি কী বলব? সেটা বলে আমি কেঁদে ফেলি, আর আমি সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলাম। কান্না থামছিল না। মৃণালদা তখন আমায় এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন, ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আমি সত্যিই কান্না থামাতে পারছিলাম না। মৃণালদার থেকে সেই প্রশংসা আমার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি ছিল।
সে সময় পরিচালক মৃণাল সেন এবং ওঁর স্ত্রী গীতা সেন দুজনের সঙ্গেই তো আপনার কাছের সম্পর্ক ছিল?
মমতা শঙ্কর: মৃণালদা একদিকে আমার বাবার মতো, দাদার মতো, আবার বন্ধুর মতো। বৌদি এবং মৃণালদা দুজনের সঙ্গে ভীষণ সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল। মৃণালদার সঙ্গে শ্যুটিংয়ের সময় খুব মজা করে কাজ করতাম, শট দেওয়ার সময় মৃণালদার একরকম মানুষ, আবার শট দেওয়া হয়ে গেল মৃণালদা পুরো অন্য মানুষ। উনি আমাদের সঙ্গে মজা করতেন, আড্ডা দিতেন, অনেক গল্প করতেন, কত কিছু শিখেছে…।
মৃণাল সেনের হাত ধরেই তো আপনার অভিনয় জীবনের শুরু 'মৃগয়া', যেটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল?
মমতা শঙ্কর: সেটা তো আমার কাছে একটা বিরাট মুহূর্ত। আমার জীবনের প্রথম ছবি। আর সেই ছবিটা না হলে হয়ত আপনারা আমায় অভিনেত্রী হিসাবে ডাকতেন না। মৃণালদা মাকে (অমলাশঙ্কর) সবসময় বলতেন, কেন আপনার মেয়ে অভিনয় করছে না? মা বলেছিলেন, ও স্কুলটা শেষ করুক, পড়শোনাটা শেষ করে নাহয় করবে। মৃণালদা বলেছিলেন, তুমি কখনও অভিনয় করতে চাইলে আমায় প্রথম খবর দেবে। আমিও ওঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। মাও মৃণালদাকে বলেছিলেন, ও ছবি করলে আপনার ছবিতেই প্রথম কাজ করবে। তখন আমার কত বয়স হবে ১৯ বছর…।
'খারিজ'-এর পর আবারও 'পালান'-এ অঞ্জন দত্ত, শ্রীলা মজুমদারের সঙ্গে কাজ করছেন, কী মনে হচ্ছিল?
মমতা শঙ্কর: এত বছর পর বলতে শ্রীলার সঙ্গে এর মাঝে একটা আমার কাজ হয়েছে। আর অঞ্জনের সঙ্গে তো আমি মাঝেও বেশকিছু কাজ করেছি। তবে ওঁদের সঙ্গে কাজ করতে আমার সবসময়ই ভালো লাগে। পুরনো সঙ্গী তো সকলে…। আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ভীষণ ভালো।
সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের মতো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, এখন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও আরও অনেকের সঙ্গেই কাজ করছেন, পার্থক্য কী মনে হয়?
মমতা শঙ্কর: পার্থক্য একটাই, মৃণালদা, সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকরা বছরে একটা সিনেমা বানাতেন। আর এখনকার পরিচালকরা বছরে অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে করেন। এটাই তফাৎ। তবে কৌশিকের মতো যাঁরা ভালো ছবি বানান, তাঁরা কাজটা ভালোভাবেই করেন, মন দিয়েই করেন। তাই অসুবিধা হয় না।
তবে টেকনিক্যালি অনেক কিছু বদলেছে। আগে অনেক অসুবিধা করে কাজ করতে হত। এখন সবকিছুতেই অনেক সুবিধা, সময় বাঁচে। তখন একটার বেশি ২-৩টে টেক দিতে হলে নিজেরই অস্বস্তি হত। এদিকে আমি আবার একটু খুঁতখুঁতে, ঠিকঠাক না হলে খুশি হতে পারি না। এখন সেটা ভাবতে হয় না। তবে এখন সময়টা খুব প্রয়োজনীয়। তাড়াতাড়ি কাজ তুলতে হয়। তখন আমার মনে হয়, কাজটাতে আরেকটু সময় দিলে আরও ভালো হত।
নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়?
মমতা শঙ্কর: কোনও অসুবিধা হয় না। আমার সঙ্গে সকলের সম্পর্ক ভালো। আমি বরং মুগ্ধ হয়ে নতুনদের কাজ দেখি। নতুনরা এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করে, আমি হয়ত এত বছর পরও সেটা পারি না।
অভিনয় ছাড়া নৃত্যশিল্পী হিসাবে আপনার আরও একটা পরিচয়, কোনটা হৃদয়ের বেশি কাছের?
মমতা শঙ্কর: (হেসে) আমার দুই ছেলে রাতুন আর ঋজুলের মধ্যে যেমন আমি পার্থক্য করতে পারব না। এই দুটোতেও পারব না।
বাংলায় রবীন্দ্রনাথের পর আপনার বাবা উদয় শঙ্কর, শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটা স্তম্ভ। তবে এখন আর ছেলেদের সেভাবে শাস্ত্রীয় নৃত্যে আগ্রহী হতে দেখা যায় না, আপনি কী মনে করেন?
মমতা শঙ্কর: না, না, তা কেন! আসেন তো। যাঁরা আসার তাঁরা ঠিকই আসেন, শাস্ত্রীয় নৃত্য শেখেন। এটা আমি ঠিক মানতে পারলাম না। তবে হ্য়াঁ, অন্যান্য নাচের তুলনায় হয়ত সেটা কম। তবে ছেলেরা শাস্ত্রীয় নৃত্যে এখনও আগ্রহী। যাঁরা করার, তাঁরা ঠিকই করেন।
নৃত্যশিল্পী হিসাবে আপনাকে কোরিওগ্রাফিতে সেভাবে কেন দেখা যায় না?
মমতা শঙ্কর: হ্যাঁ আমি করেছি। দেবদাস-এ যেমন করার কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওভাবে করা হয়ে ওঠেনি। ডেট ক্ল্যাশ করে গেল বলে। তবে আমার নাচ ভিডিয়ো করে তুলে নিয়ে গিয়েই সেই নাচ করিয়েছিলেন সঞ্জয়লীলা বনশালি। আমার অনেক মুভমেন্ট নেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ‘আবহমান’, 'বিজয়ার পরে' ছবিতেও কোরিওগ্রাফি করেছি। যেগুলোতে আমায় বলা হয়, করি।
কখনও ছবি পরিচালনাতে আসার ইচ্ছা হয়নি?
মমতা শঙ্কর: খুবই ইচ্ছে করে, তবে এখনও অতটা সাহস হয়নি। মনে হয় কেউ ছবি করে আমায় ঠিক-ভুল জিগ্গেস করলে হয়ত আমি বলতে পারব, তবে পুরোপুরি পরিচালনায় সাহস ঠিক পাই না।
আপনি ‘মৃগয়া’র পর গত বছর (২০২২) আবার মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করলেন ‘প্রজাপতি’তে। এতবছর একসঙ্গে কাজ করেননি, যোগাযোগও কি ছিল না?
মমতা শঙ্কর: হ্য়াঁ, ৪৭ বছর পর আবার কাজ করলাম। তবে আমাদের সম্পর্কটা না এগোলেও যোগাযোগটা কিন্তু ছিল। অনেক সময় আমাদের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। ওর বাড়ির সঙ্গে তো আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। মাসিমা, মেসোমশাই-এর সঙ্গে কথা হত, ওঁরা তো চলেও গেলেন। ওর বোনেদের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। মিঠুন তো ফোন ব্যবহার করে না বলে, আপাতত এখন সেভাবে ফোনে কথা হয় না। তবে ফোন যখন ব্যবহার করত, তখন কথা কিন্তু হত। আগের সম্পর্কটা তো একটা আলাদা অধ্যায়। ওটার বাইরেও আমাদের সম্পর্কটা বেশ ভালো। এখন আবার অন্য অধ্যায়। তবে মিঠুনও খুব ভালো আছে, আর আমিও ভালো আছি। তবে বন্ধুত্বটা রয়ে গিয়েছে।
অভিনয় দুনিয়া থেকে শিল্পের অন্য়ান্য ক্ষেত্র থেকেও অনেকে রাজনীতিতে আসছেন, আপনার কখনও…
মমতা শঙ্কর: (প্রশ্ন শেষের আগেই) একদম না, এক্কেবারে না। অনেকে বলেছেন, প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু নাহ। আমি রাজনীতির কিছুই বুঝি না। ওর থেকে বহু হাত ধরে।
সাংসদ, অভিনেতা দেবের সঙ্গে কাজ তো করেছেন, কেমন সম্পর্ক?
মমতা শঙ্কর: আমার ছেলেদের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক, দেবের সঙ্গেও তেমন সম্পর্ক। খুব ভালো ছেলে। আমার ওকে খুব ভালো লাগে। ও আমার ছেলেই…।
একটা অন্য কথা জিগ্গেস করছি। ফোনে আপনার কলার টিউনে বাজছিল ‘সত্য সাঁই ভজো…’। আপনি কি সত্য সাঁই-এর ভক্ত?
মমতা শঙ্কর: একদম। উনি ছাড়া আমি আর কিছুই জানি না। আমি যা করছি, উনিই আমায় দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন। আমি কিচ্ছু জানি না। এক্কেবারেই হৃদয় থেকে কথাটা বললাম…। ভীষণ বিশ্বাসী, শুধু আমি না, আমার পুরো পরিবার ওঁকে বিশ্বাস করেন, মানেন।