চলতি বছরে সাহিত্যে নোবেল পেলেন ফরাসি লেখিকা অ্যানি এরনো। বিশ্ব সাহিত্যের আসরে তিনি যথেষ্ট পরিচিত হলেও, সাধারণ পাঠকের মধ্যে বিশেষ পরিচিত নন তিনি। তাঁর নোবেল পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই ইন্টারনেটে তাঁর নাম ধরে সার্চ বেড়ে গিয়েছে। অনেকেরই প্রশ্ন, কে এই অ্যানি এরনো?
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই চলে আসা যাক, এক তরুণীর কথায়। জীবনে প্রথম বার যৌনসম্পর্কের অভিজ্ঞতা পাওয়া এক তরুণী। কেউ তাকে চায়, একথা ভাবতে যার ভালো লাগে। তার অস্বস্তি হয় না। কিন্তু সম্পর্কটির কথা ছড়িয়ে পড়তেই তার জীবন বদলে যেতে থাকে। সে হয়ে দাঁড়ায় সকলের উপহাসের পাত্রী। এত দিন যারা ছিল তার বন্ধু, তাদের কাছে এই তরুণীর আর কোনও অস্তিত্বই থাকে না। তরুণীর লজ্জা হয়। কিন্তু সত্যিই কি এই লজ্জা তার? নাকি এই লজ্জা তার থেকে যারা অন্য কিছু প্রত্যাশা করেছিল, তাদের?
এই তরুণীর কাহিনির লেখিকা অ্যানি এরনো। এ কাহিনি কখনও চলে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের পথ ধরে। কখনও সেই পথ থেকে দৌড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। ব্যক্তিগত স্মৃতিকেই দেখেন দূর থেকে। নিজের স্মৃতিকে নিজেই অবিশ্বাস করেন। নিজেকে নিজেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করান। এই হলেন অ্যানি এরনো। (আরও পড়ুন: 'কল্পনার পর্দাকে ছিঁড়ে দিতে ছুরির মতো ভাষার প্রয়োগ', সাহিত্যে নোবেল পেলেন ফরাসি)
স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ধর্মী সাহিত্যচর্চাই করেন অ্যানি। উপরে উল্লেখিত এই তরুণীর কাহিনি ২০১৬ সালে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়। পরে ২০২০ সালে সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। অনুবাদের নাম ছিল ‘আ গার্লস স্টোরি’। সেই উপন্যাস তাঁকে ইংরেজি ভাষার পাঠকদের মধ্যে আরও বেশি করে পরিচিত করে তোলে।
ফরাসি ভাষার স্মৃতিচারণ মূলক সাহিত্য চর্চা তিনি করেন। তাই বার বার তাঁর সঙ্গে তুলনা চলে এসেছে প্রায় একই ঘরানার কিংবদন্তি সাহিত্যিক মার্সেল প্রুস্তের। তিনি কি প্রুস্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত? যদিও অ্যানি বলেছেন, তাঁর উপর প্রুস্তের প্রভাব খুবই কম। বরং তাঁর উপর অনেক বেশি প্রভাব রয়েছে আমেরিকার সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের। খুব সচেতনভাবেই তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ফরাসি সাহিত্যের সব ধরনের বৈশিষ্ট্য। ভাষাটুকু বাদ দিয়ে তিনি নিজেই হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন একেবারে স্বতন্ত্র এক ঘরানা। ফরাসি ‘মিঠে বোল’, মেদুরতা, রোম্যান্টিসিজমকে বুড়ো আঙুল দেখাতেই ভালো লেগেছে তাঁর। নিজ ভাষ্যেই তিনি হয়ে উঠেছেন কর্কশ, কঠিন, এবং অবিশ্বাসী। আর সেটিই তাঁকে তাঁর নিজের দেশ, নিজের ভৌগলিক সীমারেখা, নিজের জাতিসত্ত্বার থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে।
পথের সেই বাঁকে দাঁড়িয়ে তিনি ২০২২ সালে নোবেল হাতে নিলেন, যে বাঁকে শুধুই অবিশ্বাসের ভিড়। বাকিদের চেয়েও বেশি করে নিজেকে অবিশ্বাস, নিজের স্মৃতিকে অবিশ্বাস, নিজের সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করা এবং গচ্ছিত রাখা মূল্যবান স্মৃতিসমূহকে ছুড়ি দিয়ে ফালাফালা করার জন্যই সেই বাঁকে দাঁড়ানো। যেখানে এখনও পর্যন্ত তিনি একা। ভবিষ্যৎই বলবে, ওই বাঁকেও তাঁর পিছনে লম্বা লাইন পড়ে কি না।