দেড় মাস আগে বাসভাড়া বৃদ্ধির দায়িত্ব বাসমালিকদের ওপর ছেড়েছিলেন মমতা। বলেছিলেন, ‘যাঁরা তা খরচ করতে পারবেন, তাঁরাই বাসে উঠবেন। আর যাঁরা তা পারবেন না, তাঁরা বাসে উঠবেন না।’ দেড় মাস পর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নিতে হল তাঁকে। বেসরকারি বাস চালাতে ভর্তুকি দিতে হল সরকারকে। তবে শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, বিভিন্ন সময় বারবার নিজের অবস্থান বদল করতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। শুধু অবস্থান বদলই নয়, রীতিমতো বিপরীত অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তাতে ভোগান্তির একশেষ হতে হয়েছে আম জনতাকে।
লকডাউন শুরুর আগে করোনাভাইরাস নিয়ে কেন্দ্রের নির্দেশিকাকে ‘দিল্লির দাঙ্গা ধামাচাপা দেওয়ার মতলব’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মমতা। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই তিনিই পরিণত হয়েছেন লকডাউনের সব থেকে বড় সমর্থকে। আর এখন তো কেন কেন্দ্রীয় সরকার আরও আগে থেকে লকডাউন ঘোষণা করল না তা নিয়ে রীতিমতো জবাবদিহি চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দলের নেতারা। আন্তর্জাতিক উড়ান পরিষেবা জারি রাখায় বিঁধতে ছাড়েননি মোদীকেও।
গত ৪ মার্চ দক্ষিণ মালদায় এক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দিল্লিতে কতজন মারা গিয়েছেন, তার সঠিক হিসেব কেউ জানেন না। আর মানুষ যাতে আসল করোনা (দিল্লির দাঙ্গা) ভুলে যায়, তাই ওরা টিভি-র সাহায্যে করোনাভাইরাস নিয়ে হুজুগ তৈরি করছে। শুধু করোনা করোনা করছে। যাতে মানুষ না প্রশ্ন করে দিল্লির হিংসায় কত জন মারা গিয়েছেন এবং কী ভাবে সেখানে সুবিচার পাওয়া যাবে।’
সভায় মমতা সাফ বলেন, ‘দিল্লিতে করোনায় কেউ আক্রান্ত হননি। অযথা করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না।’
সেই মমতাই মার্চের শেষে পৌঁছতে পৌঁছতে নিজেকে সব থেকে বড় করোনাযোদ্ধা প্রমাণে জান-প্রাণ এক করে দিয়েছেন। সংক্রমণের ভয় আছে জেনেও ছুটে বেড়িয়েছেন কলকাতার কোণে কোণে। অথচ বিরোধী দলের নেতারা বাড়ি থেকে বেরোলেই আটক করেছে পুলিশ।
বেসরকারি বাসের ক্ষেত্রেও ঘটেছে ঠিক একই রকম ঘটনা। বাসমালিকরাই বাসভাড়া ঠিক করবেন বলে জানিয়ে মমতা বলেন, ‘যাঁরা তা খরচ করতে পারবেন, তাঁরাই বাসে উঠবেন। আর যাঁরা তা পারবেন না, তাঁরা বাসে উঠবেন না।’ এর পরই সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয় তুমুল প্রতিক্রিয়া। ওদিকে ঝোপ বুঝে কোপ মেরে ন্যূনতম ভাড়া ২০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়ে পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে প্রস্তাব বেশ করেন বাসমালিকরা। ততক্ষণে জনতার ক্ষোভ আঁচ করে ফেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সভাসদরা। ফলে বাসমালিকদের প্রস্তাব বাতিল করেন শুভেন্দু। সঙ্গে জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাসভাড়া বৃদ্ধির বিরোধী সরকার। সঙ্গে সঙ্গে বাসমালিকরা জানিয়ে দেন, পুরনো ভাড়ায় বাস চালানো অসম্ভব। তখন বাসে ২০ জনের বেশি যাত্রী তোলা যাবে না বলে জানিয়েছিল সরকার।
এর পর পরিবহণ দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে বাসমালিকদের একাধিক বৈঠক হয়। তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বদলে বাসভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনার জন্য একটি তিন সদস্যের রেগুলেটরি কমিটি গঠন করে সরকার। তার সঙ্গেও বেশ কয়েকদফা বৈঠক হয় বাসমালিকদের সংগঠনগুলির। এর মধ্যে ২০ জন যাত্রীর বিধি শিথিল করে যত আসন তত যাত্রীর বিধি ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতেও বাসমালিকদের তরফে সাড়া মেলেনি। ফলে রাস্তায় নামেনি বাস।
গণপরিবহণ চালুর ব্যবস্থা না করেই গত ৮ জুন থেকে বেসরকারি ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ হাজিরার অনুমতি দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে বলেন, ‘করোনাকে কোলবালিশ করে ফেলুন।‘ রাস্তায় বেরিয়ে বাস না পেয়ে চরম ভোগান্তি হয় যাত্রীদের। সরকারি বাস চালিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালায় সরকার। কিন্তু তাতেও সমস্যার তেমন সুরাহা হয়নি। উলটে রাস্তায় বাস কম থাকায় যে কটি বাস ছিল তাতে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং শিকেয় ওঠে। যে সব রুটে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানা হয়েছে সেখানে বাসে আসন না থাকায় প্রথম স্টপেজের পর আর বাসে উঠতে পারেননি যাত্রীরা। ফলে লকডাউনের জেরে আর্থিক অনটনের মধ্যেই কয়েকগুণ খরচ করে অফিসে পৌঁছতে হচ্ছে বহু মানুষকে।
বেসরকারি বাস পরিষেবা পুরোদমে শুরু করতে বাসমালিকদের ভর্তুকি দেওয়ার দাবি তুলতে থাকে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি ছিল, সরকার ক্লাবকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিতে পারলে বাসমালিকদের দিতে পারে না কেন? অবশেষে সেই পথেই হাঁটতে হল সরকারকে। জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ভাড়া না বাড়িয়ে ভর্তুকির পথে হাঁটলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার দাম চোকানোর ব্যবস্থা হল সাধারণ মানুষের করের টাকায়। যিনি হয়তো কোনও দিন বাসই চড়েন না।
সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, কেন বার বার অবস্থান বদলাতে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীকে? কেন দৃঢ় অবস্থান নিয়েও ফিরে আসতে হয় তাঁকে। মমতাকে যাঁরা দীর্ঘদিন চেনেন তাঁরা জানাচ্ছেন, সাধারণত কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা ঘোষণার আগে কারও সঙ্গে পরামর্শ করার দরকার মনে করেন না মমতা। একাই সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করেন তিনি। আর নিজেকে প্রত্যয়ী দেখাতে দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তিনি। যাতে কারও কোনও আপত্তি থাকলেও তাঁর প্রত্যয়ের সামনে খড়কুটোর মতো তা উড়ে যায়। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানের পর ছবিটা বদলে গিয়েছে। সেটা সম্ভবত এতদিন বুঝে উঠতে পারেননি তৃণমূলনেত্রী। এখন রাফ – অ্যান্ড ফরমুলায় কাজ হবে না বুঝেই তাই ফের সর্বদল ডাকতে হয়েছে তাঁকে। বদলাতে হচ্ছে ঘোষিত সিদ্ধান্ত।