দীর্ঘদিন বিছানায় শয্যাশায়ী। প্রকাশ্য়ে আসতেন না সেভাবে। দুই মেয়ে আগলে রেখেছিল, তবে শেষরক্ষা হল না। শনিবার প্রয়াত হলেন বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের নায়িকা অঞ্জনা ভৌমিক। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। দীর্ঘদিন ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত সমস্যায়।
শুক্রবার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে অঞ্জনা দেবীকে ভর্তি করা হয় দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। আজ সকালে সাড়ে ১০টা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উত্তম কুমারের ‘চৌরঙ্গী’ নায়িকা। তিন দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন অঞ্জনা ভৌমিক। সাদাকালো যুগের অন্যতম আকর্ষণীয় নায়িকা, হাতেগোনা ছবি করেও স্বমহিমায় উজ্জ্বল অঞ্জনা ভৌমিক। তাঁর সাবললীল অভিনয়, মিষ্টি হাসি আর অন্যরকম সৌন্দর্যই তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি। উত্তম কুমারের সঙ্গে একের পর এক স্মরণীয় ছবিতে অভিনয় করেছেন।
১৯৪৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর মাসে কোচবিহারে জন্ম। তখন অবশ্য অঞ্জনা নয়, তাঁর নাম ছিল আরতি। সুনীতি অ্যাকাডেমি স্কুলের কৃতি ছাত্রী আরতির পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলাতেও ঝোঁক ছিল। কর্মসূত্রে বাবা বদলি হয়ে আসেন কলকাতায়, পরবর্তীতে আরতি ভর্তি হন সরোজিনী নায়ডু কলেজে।
তখন বয়স সবে ২০, আরতি (ওরফে অঞ্জনা) অভিনয় করলেন পীযূষ বসুর ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’তে। পালটে ফেললেন নিজের পরিচয়। ছকভাঙা সুন্দরী হিসেবে পরিচিত মহলে পরিচিতি ছিল তাঁর, তবে অভিনয়ের জগতে পা দেবেন কখনও ভাবেননি। কিন্তু ললাট লিখন টলায় কে!
বাংলা ছবির জগতে সবচেয়ে প্রিয় জুটি উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম-সুপ্রিয়া জুটিও কম ঝড় তোলেনি পর্দায়। কিন্তু সেই ভিড়েও আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল উত্তম-অঞ্জনা জুটি। মহানায়কের নায়িকা হিসাবে ‘চৌরঙ্গী’, ‘নায়িকা সংবাদ’, ‘কখনও মেঘ’, ‘রৌদ্র ছায়া’, ‘রাজদ্রোহী’-র মতো ছবিতে দর্শক দেখেছে অঞ্জনা। মনের মণিকোঠায় গেঁথে রয়েছে এই ছবিগুলো।
বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের নায়িকাদের মধ্য়ে অঞ্জনা ভৌমিক তাঁর সবচেয়ে প্রিয় একথা আগেও বহুবার বলেছেন সৃজিত। অভিনেত্রীর মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘অতি উত্তম’ পরিচালক লেখেন- ওঁনার স্পনটেনিয়েটি এবং টাইমিং উদাহরণযোগ্য, উত্তম কুমারের সঙ্গে ওঁনার রসায়ন সবচেয়ে সেরা। হ্য়াঁ, এটা আমি সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়াম দেবী এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে মাথায় রেখেই বললাম'।
উত্তম কুমার নির্ভরশীলতার অভিযোগ উঠলে ছক ভেঙেছিলেন অঞ্জনা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে মহাশ্বেতায় অভিনয় করেছিলেন। ‘নিশিবাসর’, ‘সুখে থাকো’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘শুক সারি’র মতো জনপ্রিয় বাংলা ছবির সাফল্যের অন্যতম কাণ্ডারী অঞ্জনার প্রাণঢালা অভিনয়। থানা থেকে আসছি’ ছবিতে বড়লোকের বেটি-র ভূমিকায় তাঁর অভিনয় আজও ভুলতে পারেনি বাঙালি।
বিয়ের পরে অঞ্জনা স্বামীর সঙ্গে মুম্বইয়ে সংসার পাতেন। একটু একটু করে সরে যেতে থাকেন অভিনয় জগত থেকে। দুই কন্যা সন্তান নীলাঞ্জনা ও চন্দনাকে ঘিরেই ছিল তখন তাঁর জগত। তাঁর দুই কন্যেও পরবর্তীতে অভিনয়ের জগতে এসেছিলেন। বড় জামাই যিশু সেনগুপ্ত বাঙালির প্রিয় অভিনেতা।
শেষজীবনে সেভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সুবাদে উমা মুক্তির সময় দেখা মিলেছিল সারার দিদিমার। করোনা লকডাউনে নীলাঞ্জনা মায়ের সঙ্গে স্বামীর একটি আদুরে ভিডিয়ো শেয়ার করেছিলেন। তবে মূলত লোকচক্ষুর আড়ালেই কেটেছে অঞ্জনা ভৌমিকের শেষজীবন।