পীযূষ দত্ত
দোরে দোরে চোদ্দ প্রদীপ টিমটিম করবে। হেমন্তের বিষণ্ণ শুষ্ক হাওয়ায় অন্ধকার সামান্য গাঢ় হবে। এই সন্ধেটায় ঝুপঝাপ কিছু বাজির শব্দের সঙ্গে থাকবে একটা স্তব্ধতা। কোথাও কোনও কুকুরের নম্র কান্না। আর এরই মাঝে বাঙালির ঘরে ঘরে চুপিসারে উচ্চারিত হবে তাদের অতীব কাছের একটি শব্দ, ‘ভূত’।
এই ‘ভূত’ শব্দটি কানের কাছ ঘেঁষলে বুকটা যেমন ক্ষনিকের জন্যে হলেও ছ্যাত করে ওঠে, আবার তেমনই এই ‘ভূত’ একাধিকভাবে ফিরে আসে বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়। ছোটোদের শোনানো ঘুমপাড়ানি গল্প থেকে চলচ্চিত্র, এমনকী একালের ইউটিউব কন্টেন্টেও, কোথাও বাঙালির পিছু ছাড়ে না এই ‘ভূত’।
আমরা বরং আলোচনা করি বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে। ভীতসন্ত্রস্ত অথচ যুক্তিশীল বাঙালি তাঁদের ছবিতে ভূতকে যেন স্বীকার করেও, একপ্রকার না জানার ভান করে এড়িয়ে গেছে বারংবার। ছবিতে ভূত থাকলেও, কেমন যেন ঘাড় ধরে দেখিয়ে দিতে হয়েছে পরিচালককে, যে আদপেই ভূত-ফূত হয় না। ওসব আজগুবি গল্প মাত্র। তবে সময়ের সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্র সে গন্ডিও ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। বাংলা ছবিতে নতুন করে, চমৎকার রসবোধের সঙ্গে ফিরে এসেছে ‘ভূত’, অথবা বলা ভালো বাঙালির ভূত।
মূল আলোচনায় ঢোকার আগে এই ‘বাঙালি ভূত’ বিষয়টিকে একবার ছুঁয়ে নেওয়া যাক। এই ভূতের ধারণা, স্থান-কাল বিশেষে পরিবর্তিত হয়। এবং নিঃসন্দেহে তার প্রভাব চলচ্চিত্রেও পড়ে। ধরা যাক জাপান। জাপানের সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে ভূত বিষয়টা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঠিক বাংলার মতোই। জাপানে এই ভূতকে বলা হয় ‘ইউরেই’ (Yurei)। জাপানের চলচ্চিত্রে ভূতের আচার আচরণ, কণ্ঠস্বর, সাজ পোশাক, এই সব কিছুই তৈরি হয়েছে এই ‘ইউরেই’-এর ধারণা থেকে। উদাহরণ হিসেবে আমরা মোটোয়োসি ওডার ছবি ‘ইউরেই কোকো’ ছবিটা ধরতে পারি। ঠিক একই রকম ভাবে তৈরি হয়েছে এই বাঙালি ভূত। যা মূলত জনসমাজে পেত্নি, শাকচুন্নি নামে পরিচিত। বাংলার ছবিতেও যে ভূতের দেখা মেলে, তার সঙ্গে এই পেত্নি বা শাকচুন্নির সামঞ্জস্য রয়েছে।
আরও মজার জিনিস হল বাংলা চলচ্চিত্রে ভূতের বিবর্তন। উদাহরণ হিসেবে আমরা সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’ ছবিটির ‘মণিহারা’-কে ধরতে পারি। ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় এই ‘তিন কন্যা’। গল্পে ভূতের আবির্ভাব এবং তিরোধানের মধ্যে সত্যজিৎ যেন তাঁর যুক্তিবাদী সত্ত্বাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রেখেছেন। যেখানে শেষে ভূতের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে সামান্য সংশয় বোধ দর্শকের মনে রেখে যান সত্যজিৎ রায়।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের এই কঠোর যুক্তিবাদী সত্ত্বা খানিক ভোঁতা হতে শুরু করে। তার বদলে ধারালো হতে থাকে বাঙালির রসবোধ। তার নমুনা পাওয়া যায়, ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এ। অনীক দত্ত পরিচালিত এই ছবিতে একাধিক যুগের, একাধিক রকমের ভূতের দেখা পাওয়া যায়। আদ্যিকালের রক্ষণশীল বাংলার ভূত, উদ্বাস্তু ভূত, নব্য যুগের ভূত, পলাশীর যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া ভূত, বিপ্লবী ভূত, একাধিক রকম ভূতের সমাগম। এবং এদের অধিকাংশের চলন-বলনে এই বাঙালি ভূতের ছাপ লক্ষনীয়। এই ছবিতে পরিচালক শেষ পর্যন্ত ভূতের ধারণাটি জিইয়ে রাখেন। একবারের জন্য দর্শকের মন থেকে এই ধারণা মোছবার চেষ্টা করেন না। এই ছবির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র ফুটিয়ে তোলা। চমৎকার রসবোধের সঙ্গে এই কাহিনি গঠন করেন পরিচালক। এই বিবর্তনটা চোখে ধরে। ‘ভূত নেই’ জাতীয় ন্যারেটিভকে নাকচ করা এই ছবির কাহিনির ক্ষেত্রে জরুরি ছিল।
অন্যদিকে অপর্ণা সেনের ছবি, ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গয়নার বাক্স’-র দিকে নজর ফেরাতে পারি আমরা। এই ছবিতে পরিচালক আরও স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলেন বাঙালি ভূতের ধারণাটিকে। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এ বাঙালি ভূত বাদেও বেশ কিছু চরিত্র ছিল, তবে এই ছবিতে সামনে ছিল বাঙালি ভূত। এবং ভূতকে কেন্দ্র করে একজন গার্হস্থ্য নারীর প্রতিক্রিয়া। বাংলার লোককথায় যে পেত্নি বা শাকচুন্নির ধারণা পাই, তাকেই যেন পরিচালক খানিক সচেতনভাবে রেখে গিয়েছেন গোটা ছবি জুড়ে। এই ছবিতেও যা লক্ষনীয়, পরিচালক দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগানোর বদলে নজর দিয়েছেন বাঙালি ভূতের ধারণা, সেই সময়ের আর্থ সামাজিক কাঠামো এবং সমাজে নারীদের অবস্থানের উপর। এই ছবির কাহিনির মূল ছন্দ ছিল রসবোধ।
তবে আলোচ্য বিষয় হল এই বিবর্তনটি। যা শেষ ১০-১১ বছরে বাংলা চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে। যেখানে ধীরে ধীরে ভূতের ধারণা ভিত জমাতে শুরু করছে বাংলা চলচ্চিত্রে। যখন বাংলার পরিচালকরা যুক্তিবাদকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বদলে আরও চোস্তভাবে ভূতের ধারণাটিকে ব্যবহার করছেন সমাজের আরও দশটি সমস্যাকে চিহ্নিত করতে।
এই ভূতচতুর্দশীর রাত, আমাদের সামনে পর্দায় দেখা সেই বাঙালি ভূতের ছবিকেই ফিরিয়ে আনে।