‘ডন কো পাকড়না মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়!’ হিন্দি ছবির অতি পরিচিত, চর্চিত জনপ্রিয় এই ডায়ালগকে যদি একটু বদলে নেওয়া যায়। ‘ডন’ শব্দটি বদলে শুধু বসিয়ে নিন ‘হুব্বা’, তারপর বাকিটা এক। তবে 'ডন'-এর ত্রাস ছিল ফিল্মি কায়দায়। 'হুব্বা'র দাপট কিন্তু পুরোটাই বাস্তব। সিনেমাতে কিছু নাচাগানা বাদ দিলে বাকিটা পুরোটাই বাস্তবোচিত। ব্রাত্য বসুর ছবিতে কোথাও কখনও কিছু নকল বলে তো মনে হল না। 'হুব্বা' বিমলের এই দাপট মনে করিয়ে দিল হুগলির সেই 'ডন' হুব্বা শ্যামলের কথা।
হুগলির কোন্নগর, রিষড়া সহ বিভিন্ন এলাকায় একসময় ‘হুব্বা’র নাম শুনলে লোকে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতেন। সেটা ২০০৪-২০০৫ সাল, যদিও বহু ছোট বয়সেই অপরাধে হাতেখড়ি হয় বিমলের, সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকে… । শুরুর দিকে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, তারপর ধীরে ধীরে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন বন্ধ কারখানা লুঠ করা, প্রমোটারি, সিন্ডিকেট, দালালি সবই চলত। তবে এখানেই শেষ নয়, নৃশংসভাবে খুন করায় সিদ্ধহস্ত ছিল ‘হুব্বা’। মানুষ খুনেই নাকি তাঁর আসল আনন্দ। ছবিতে হুব্বার মুখে শোনা গেল, ‘আমার কীসে চলকায় জানিস? মার্ডারের পর গরম রক্তটা যখন ছিটকে এসে মুখে লাগে…’।
এই মস্তানি আর অপরাধের দুর্গে হুব্বার ছিল নিজস্ব দলবল। এদের মধ্যে কেউ তাঁর ডানহাত, তো কেউ বাঁহাত। তবে গদি যাতে নিজের দখলে থাকে, তাই হুব্বার সাফ কথা, ‘মনে রাখবি গাড়িটা কিন্তু আমি চালাচ্ছি’। এছাড়াও বহু লোকজন হুব্বার হয়ে কাজ করত। ‘হুব্বা’র নেটওয়ার্ক ইন্টারনেটের থেকেও 'ফাস্ট'। হুব্বার সাম্রাজ্য ভেদ করে তাঁকে গ্রেফতার করা একপ্রকার 'মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন' হয়ে উঠেছিল। কথায় বলে ‘দেওয়ালেরও কান আছে।’ তবে এখনে শুধু দেওয়াল নয়, পুলিশ কখন, কোথায়, তাঁকে ধরতে জাল ফেলে রেখেছে, তা জানতে হুব্বার কান যেন সর্বত্র পাতা।

'হুব্বা'র চরিত্রে মোশারফ
'হুগলির দাউদ' বলে খ্যাত এমনই এক দুষ্কৃতীই ব্রাত্য বসুর 'হুব্বা', ছবির নায়ক। ছবির শুরুতে হুব্বা (মোশারফ করিম)কে ধরতে উঠে পড়ে লাগেন জাঁদরেল IPS অফিসার দিবাকর সেন (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত)। শুরু হয় ইঁদুর-বিড়াল খেলা। তবে এই ইঁদুরকে ধরা কিন্তু মোটেও সহজ নয়। নাকানি-চোবানি খেতে হয় পুলিশকে। বারবার ফাঁদ পেতেও ঘোল খেতে হয়। পুলিশকে ঘোল খাওয়ানো ‘হুব্বা’র যে বাঁহাতের খেল। ছবিতে IPS অফিসার ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের কথায়, ‘অশিক্ষিত কিন্তু স্ট্রিট স্মার্ট’। এই হুব্বার আবার একাধিক ফোন, অসংখ্য নম্বর। কখন, কোনটা চালু থাকবে, কখন কোনটা বন্ধ, সেটাও ঠিক করে একমাত্র হুব্বা। তারপরেও সেই ফোনে আড়ি পেতে 'হুগলির এই দাউদ'কে ধরার ছক কষা হয়। বহু বছর ধরে ব্যর্থ হলেও আইপিএস দিবাকর সেনের (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) নেতৃত্বে একসময় হুব্বাকে ধরে ফেলে পুলিশ। চলে জিজ্ঞাসাবাদ। হুব্বার বয়ানেই ছবিতে উঠে আসে তাঁর ছোটবেলা, পরিবার, বাবা-মা, প্রথম প্রেম ও বিয়ের কথা, উঠে আসে অপরাধের দুনিয়ায় তাঁর পথ চলা শুরুর কথা। এভাবেই ফ্ল্যাশব্য়াকে সাধারণ বিমলের 'হুব্বা' হয়ে ওঠার গল্প বলে ফেলেন ব্রাত্য বসু। এরই মধ্যে মিশেছে বেশকিছু গান, কিছুটা ফিল্মি কায়দা।
যদিও একসময় শত চেষ্টা করেও হুব্বাকে আটকানো যায়নি, ক্ষমতার বলে হুব্বা জামিন পেয়ে যায়। তবে পুলিশ বসে থাকে না। ফের নতুন জাল বুনতে থাকে। একসময় হুব্বাকে মেরে ফেলে তাঁর অতিব ঘনিষ্ঠ লোকজন। খালের জলে ‘হুব্বা’র দেহ উদ্ধার হয়।
এই ছবিতে ভীষণই সুন্দর মুন্সিয়ানায় হুব্বার সাম্রাজ্য, তার বিস্তার, দাপট, অপরাধের দুনিয়া তুলে ধরেছেন পরিচালক ব্রাত্য বসু। হুব্বার গল্পের সমান্তরালে উঠে এসেছে পুলিশ আধিকারিক ইন্দ্রনীলের কর্মজীবন, তাঁর পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবনের গল্প। যদিও সেই গল্পটা রয়েছে ভীষণই স্বল্প পরিসরে। এছবি মূলত 'হুব্বা'ময়। আর তাঁর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জুড়েছে ভোট রাজনীতির কথা, কিছু নিচুতলার রাজনৈতিক নেতাদের ইন্ধন জোগানোর ছবি, আবার অপরাধী ‘হুব্বা’র অল্পবয়সের প্রেমজীবনের কিছু ছবিও তুলে ধরা হয়েছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, বাংলার প্রেক্ষাপটে আরও একটা 'ডন' বানিয়ে ফেলেছেন পরিচালক ব্রাত্য বসু। যে গল্প ফিল্মির থেকেও অনেক বেশি বাস্তব। তবে আবার 'হুব্বা'তে মিশেছে বাণিজ্যিক বাংলা ছবির মশলাও। সব মিলিয়ে পাকা রাঁধুনির মতোই এই রান্নাটা করেছেন পরিচালক ব্রাত্য বসু। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেভাবে কোনও ফাঁকফোকর নেই। কোথাও সেভাবে মনে হবে না, এই মশলার পরিমাণটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছে, আরেকটু কম হলে ভালো হত। বলা ভালো 'হুব্বা' বেশ পোক্ত হাতে তৈরি ছবি, যেখানে আগাগোড়া বিনোদনের সব রসদই রয়েছে। আবার তাতে কোথাও এতটুকু বাড়াবাড়ি নেই। গল্পটা কোথাও বাস্তব না মনে হয়ে অতিরিক্ত ফিল্ম মনে হয়নি।

‘হুব্বা’র চরিত্রে গম্ভীরা ভট্টাচার্য
(ট্রেলারের স্ক্রিনশট)
'হুব্বা'র দৃশ্য়
(ট্রেলারের স্ক্রিনশট)ছবি দৃশ্যায়নের প্রসঙ্গে আসা যায়, সেখানেও সুন্দর বিশ্বাসযোগ্যভাবে সবকিছুকে তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তব ঘটনাকে কোথাও গিয়ে অবাস্তব করে তোলা হয়নি। আর এই কৃতিত্বটা সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদারকে দিতেই হয়। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা হল অভিনয়। ছবির 'হুব্বা' বাংলাদেশের অভিনেতা মোশারফ করিম সেটা সফলতার সঙ্গেই করেছেন। তাঁর নিপুণ অভিনয়ে কোথাও খুঁত ধরার উপায় সত্যিই নেই। মোশারফের থেকেও ভালো 'হুব্বা' কেউ হতে পারতেন বলে সত্যিই মনে হয় না। তবে শুধু মোশারফ নন, অভিনয়ে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন অল্পবয়সী ‘হুব্বা’, অভিনেতা গম্ভীরা ভট্টাচার্য। তাঁর চোখ, মুখ, অভিব্যক্তি সবকিছুই 'হুব্বা' চরিত্রটিকে আরও বেশি ‘ভয়ানক’, আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। সবথেকে বড়কথা মোশারফ করিমের মতো দক্ষ অভিনেতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিনয় করেছেন গম্ভীরা। এত সুন্দর সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিনয় যে দুই 'হুব্বা'কে কখনও আলাদা ব্যক্তি বলে মনেই হয়না। বিশেষভাবে নজর কাড়ার মতো বাংলাদেশের মোশারফ করিমের বাংলা উচ্চরণ, খুবই যৎকঞ্চিৎ ছাড়া কোথাও তাঁর উচ্চারণে এতটুকু বাংলাদেশের বাংলা টান খুঁজে পাওয়া গেল না।
পুলিশ আধিকারিকের ভূমিকায় ভীষণই পারফেক্ট ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। হুব্বার স্ত্রী 'তাপসী'র চরিত্রে নজর কেড়েছেন অভিনেত্রী জিনিয়া রায়। তাঁর অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। অন্যান্য বাপী, উমেশ, হুব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী মিতালীর চরিত্রে লোকনাথ দে, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, অস্মিতা মুখোপাধ্যায়দের অভিনয়ও প্রশংসনীয়। গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবির ব্যকগ্রাউন্ড স্কোর, ছবির গানগুলিও কিন্তু বেশ বিনোদনমূলক। সঙ্গে ছবিটাকে টানটান, যথাযত বুননে মেলে ধরেছেন সম্পাদক সংলাপ ভৌমিক। ছবিকে পারফেক্ট করে তুলতে তাঁর কৃতিত্ব কিন্তু অনেকটাই। সবমিলিয়ে ব্রাত্য বসুর 'হুব্বা' ৫-এ সাড়ে ৪ দেওয়া যায়। এবার 'হুব্বা'কে দর্শকদের কতটা মনে ধরবে তা ১৯ তারিখ, শুক্রবার ছবি মুক্তির পরই বোঝা যাবে।