‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥’ শ্রীমদ্ভগবতগীতায় শ্রীকৃষ্ণের এই বাণীর সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। যার অর্থ যখনই পৃথিবীতে অধর্ম ছেঁয়ে যায়, তখন সেই অধর্ম ও বিধর্মীদের বিনাশ করতে তিনি (শ্রীকৃষ্ণ) জন্ম নেন। এভাবেই বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন অবতারে জন্মগ্রহণ করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, কলিযুগের শেষেও কল্কি অবতারে পাপ ও পাপীদের নিশ্চিহ্ন করতে আরও একবার জন্ম নেবেন শ্রীকৃষ্ণ। আর পাঁচজনের মতো এমনটাই মনে করেন যিশু। অন্যদের সঙ্গে পার্থক্য হল তিনি শুধু মনেই করেন না, ‘ভগবান বিষ্ণু’র 'কল্কি' অবতার হিসাবে নিজেকে কল্পনা করেন।
কল্পি রূপে কৃষ্ণ আসবেন সাদা ঘোড়ায় চড়ে, তলোয়ার হাতে, সোনার মুকুট পরে। নিজেকেও এভাবেই কল্পনা করেন যিশু। তলোয়ার হাতে সাদা ঘোড়ায় চড়ে আসছেন, আর একের পর এক পাপীদের নিশ্চিহ্ন করছেন, শাস্তি দিচ্ছেন। হিন্দু পুরাণের সেই গল্পের ছাঁচেই ক্রাইম থ্রিলার, সিরিয়াল কিলিং-এর গল্প লিখেছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। হ্যাঁ, যিশুই এখানে 'খলনায়ক', এই ইঙ্গিত ট্রেলারেই ছিল। যিশুকে বলতে শোনা গিয়েছিল 'আমি এই পৃথিবীতে এসেছি জাস্ট কয়েকদিনের জন্য, কয়েকটা জঞ্জাল সাফ করে আবার চলে যাব।' বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আমার সঙ্গে ঈশ্বর কথা বলে…’, খানিকটা কাব্যিক স্টাইলে, কবির মতো করে শোনা গিয়েছিল। হ্যাঁ, এই ছবির চিত্রনাট্যের সঙ্গে কিছু কবিতাকেও অন্যরকমভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন সৃজিত। সেসব অবশ্য এখানে বলা যাবে না, বললে সিনেমার মজাটাই চলে যাবে।
এবার আসা যাক, গল্পের দুই নায়ক প্রবীর রায় চৌধুরী (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) আর বিজয় পোদ্দারের (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) কথায়। এই গল্পে সৃজিতের 'তুরুপের তাস' তাঁরাই। নাহ, অন্যান্য মশলাদার বাণিজ্যিক ছবির কায়দায় তাঁদের 'দাবাং' স্টাইলে দেখানো হয়নি। বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই 'দশম অবতার'-এর চরিত্রায়ণ করেছেন সৃজিত। প্রবীর ও বিজয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরেন, ‘মগজাস্ত্র’ তাঁদের অত্যন্ত প্রখর। সিরিয়াল কিলারের জটিল ছক ধরা 'জিনিয়াস' প্রবীর রায়চৌধুরীর কাছে তো নয়ই, বিজয়ের কাছেও এমন কিছু কঠিন নয়। আর যদি আসি জয়া আহসানের কথায়, তাহলে বলব 'সিরিয়াল কিলার'-পুলিশ আর রক্তের গন্ধ মেশা এই খেলায় ‘পেলব’ সুর হয়ে ধরা দিয়েছেন জয়া।
ছবির গল্পের কথায় যদি আসি, তাহলে বলব, 'দশম অবতার'-এর গল্প অতটাও জটিল নয়, যতটা ‘২২ শ্রাবণ’, আর ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর ক্ষেত্রে ছিল। ‘২২ শ্রাবণ’, আর ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর চিত্রনাট্যে যে মুন্সিয়ানা ছিল, তাতে ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত, গল্পের আসল রহস্য বোঝা ছিল মুশকিল। তবে 'দশম অবতার'-এর গল্প আপনি প্রথম থেকেই অনেকটা আন্দাজ করতে পারবেন। তাই এখানে গল্প নিয়ে নতুন কিছুই বলার নেই। তবে আগের ওই দুটি ছবির সঙ্গে 'দশম অবতার'-এর পার্থক্য হল এটা অগের দুটির থেকে অনেক বেশি ‘mass film’ হিসাবে বানানো হয়েছে। এই গল্পে খুনি কে তা সবাই জানেন, তবে ‘২২ শ্রাবণ’ আর ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর ক্ষেত্রে Back Story-তে যেমন চমক ছিল, এখানে সেই চমকটা সেভাবে নেই। মনে হবে, শেষে এমনই কিছু একটা হওয়ার ছিল। এখানে কে খুন করছেন, সবাই জানেন। প্রশ্ন হল মোটিভ কী? কীভাবে তাঁকে ধরা হবে? এটাই গল্পের মূল বিষয়।
তবে ‘দশম অবতার’-এর চিত্রনাট্যে ভালো লাগার যে জায়গা, সেটা হল বিষ্ণুপুরাণের সঙ্গে এই সিরিয়াল কিলিং-এর গল্পকে সুন্দরভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ভালো লাগে প্রবীর রায়চৌধুরী হিসাবে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের লুক, অভিনয়, বিজয় পোদ্দার হিসাবে অনির্বাণের অভিনয়। উফ! আধুনিক ভাষায় বললে, এককথায় ওঁরা ‘ফাটিয়ে’ দিয়েছেন। তবে প্রসেনজিৎ নাকি অনির্বাণ, কে বেশি দর্শকদের চোখ টানবেন? কে কাকে ছাপিয়ে যাবেন? এর উত্তর পেতে ছবিটা দেখতে হয়, না হলে এই দুটি চরিত্রের মজাটাই ‘মিস’ করবেন। তবে খুনির চরিত্রে মন কেড়েছেন যিশু সেনগুপ্ত। যিশুর শীতল দুই চোখ, ঠাণ্ডা একটা ব্যক্তিত্বের মধ্যেও তিনি অনেক কিছু করে ফেলেছেন। যিশু যেভাবে নিজের চরিত্রটি উপস্থাপনা করেছেন, তাতে তাঁর প্রশংসা করলেও কম হয়। আর যদি আসি জয়া আহসানের কথায়, এই গল্পে তাঁর বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দক্ষ অভিনেত্রী হিসাবে তিনি নিজের চরিত্রে ভালো কাজ করেছেন। তবে সব 'লাইম লাইট' চুরি করে নিয়েছেন প্রসেনজিৎ, অনির্বাণ ও যিশু। অনির্বাণ-জয়ার রসায়নটাও মন্দ নয়। তবে এটাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে প্রবীর-পোদ্দারের কেমিস্ট্রি। এটা ‘জাস্ট’ জমে গিয়েছে।
প্রবীর রায়চৌধুরী হিসাবে এখানে প্রসেনজিৎ-এর এন্ট্রি সেভাবে নজর না কাড়লেও, বিজয় পোদ্দারের এন্ট্রিটা নজর কাড়ে। প্রবীর-বিজয়ের প্রথম সাক্ষাৎ-টাও দারুণ। দর্শক হিসাবে এই জায়গাটা বেশ উপভোগ করার মতো। মানে চাইলে তাঁদের ডায়ালগ শুনে হলে বসে ‘সিটি’ দিতে পারবেন। এদিকে গল্প, চিত্রনাট্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সৌমিক হালদারের সিনেমাটোগ্রাফি, পরিচালক সৃজিতের মেকিং, প্রণয় দাশগুপ্তের সম্পাদনা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই ছবির আরও একটা ভালো লাগার জায়গা সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, ছবির মিউজিক। ছবিতে অনুপম রায় আর রূপম ইসলামের গানগুলি সত্যিই সৃজিতের আগের ছবির গানগুলির মতোই মন ছুঁয়ে যায়।