যে গায়ক-গায়িকার হাত ধরে ‘রবিবাবুর গান’ বাঙালির প্রাণের ‘রবীন্দ্রসংগীত’ হয়ে উঠল, তাঁদের অন্যতম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯২৪ সালে জন্ম। গত অক্টোবরে কণিকার শান্তিনিকেতন বাসভবনে তাঁর জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। তার ফাঁকেই হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে আলাপচারিতায় কণিকার প্রিয় ছাত্রী। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
প্র: রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া ছাড়াও দীর্ঘদিন সংগীতভবনের অধ্যাপিকা ছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে কীভাবে পেয়েছেন ক্লাসে?
রেজওয়ানা: মোহরদির সবচেয়ে রিমার্কেবল টেকনিক হল যে কোনও গান সহজ করে শেখানো। শুনে মনে হত, এ ভীষণ সোজা সুর। হারমোনিয়াম থাকত না, তানপুরা বাজাতাম। স্বরলিপি মনে থাকলে নিজে নিজেই, নয়তো দেখে দেখে গানটা গাইতেন। কমপক্ষে ছয় থেকে দশবার গাইতেন। এতে জটিল অংশগুলি আগেই চোখে পড়ত না। আরেকটা মনে রাখার মতো ব্যাপার ওঁর উৎসাহ দেওয়া। ‘বাহ, এই তো বেশ হচ্ছে’ — এমনটা বলে বারবার উৎসাহ দিতেন। কক্ষনও কাউকে বলেননি — ‘না হচ্ছে না, না হয়নি।’ শুধরাতে হলে বলতেন —‘এই জায়গাটা একটু এইভাবে হবে।’ উনি যখন প্রিন্সিপাল ছিলেন সপ্তাহে তিনটে ক্লাস নিতেন।
পরে যখন আলাদাভাবে শিখেছি, তখন ছোট ছোট ডিটেলিং যেমন থ্রোয়িং, মডিউলেশন, এক্সপ্রেশন, ভয়েস নোট লাগানোর টেকনিকগুলো শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এগুলো ক্লাসে পাইনি। সবার সঙ্গে উনি শেয়ার করতেন না। হয়তো সবাই ভালোভাবে দেখবে না বলেই বলতেন না।
প্র: কীভাবে রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতনের প্রতি আগ্রহ জন্মাল? তখন তো সদ্য স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। কীভাবে এখানে পড়তে এলেন?
রেজওয়ানা: শান্তিনিকেতন আমার স্বপ্নের জায়গা। বাড়িতেও রবীন্দ্রনাথ খুব চর্চিত ছিলেন। ছোট থেকেই তাঁর লেখা পড়তাম। পূর্ব পাকিস্তান হলে হয়তো কখনই আসতে পারতাম না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুযোগ পেয়েই চলে আসি। ম্যাট্রিক পাশ করি ৭২-এ, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি ৭৫-এ। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি অনার্স নিয়ে ভর্তি হই। তিন-চার মাস ক্লাস করার পর আইসিসিআর স্কলারশিপ পেলাম। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স করার জন্য সেটি দেওয়া হয়। তাতে শান্তিনিকেতন আসা আরও সহজ হয়ে গেল।
প্র: কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে গতকাল এখানে এসেছেন। তাঁর বোন বীথিকা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ সময়ও কাটিয়েছেন। গল্প করতে করতে কণিকা সম্পর্কে কোনও ব্যক্তিগত স্মৃতি উঠে এসেছে যা পাঠককে বলা যায়?
রেজওয়ানা: এই বাড়ির (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ‘আনন্দধারা’) সঙ্গে আমার সম্পর্ক একেবারেই পারিবারিক। আমার দুই খুদেকে নিয়ে এই বাড়ির পিছনের বাড়িতেই থাকতাম। আমার খুব সৌভাগ্য যে মোহরদি আমার কাছে ওপেন ছিলেন। তখন তো বয়স হয়ে গিয়েছিল। ওঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা কথা বলতেন। আমিও একইভাবে নিজের কথা বলতাম তাঁকে।
প্র: কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠমহলের অনেকের অনুযোগ, ছাত্রী হলেও আপনি অনেক বেশি গুরুত্ব পেতেন। এর পিছনে কোনও বিশেষ কারণ?
রেজওয়ানা: দেখো, পরিবার তো পরিবারই হয়। আসলে আমি গান শেখায় অনেক সময় দিতাম। সকাল হলেই চলে আসতাম এই বাড়ি। গান তোলার জন্য বসে পড়তাম। এর মধ্যেই বাড়িতে অতিথিরা যাতায়াত করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে মোহরদিকে। কোনও কোনও দিন গান শেখাই হত না। আবার কোনও কোনও দিন সারাক্ষণই গানের চর্চা চলছে। দুপুর পর্যন্ত শিখে বাড়ি চলে যেতাম। আবার বিকেলে চারটে পাঁচটা নাগাদ চলে আসতাম। দেরি হলে দিদি খবর নিতে লোক পাঠাত, কেন দেরি হচ্ছে। অনেকটা সময় দিয়েছি বলেই হয়তো একটা আলাদা টান তৈরি হয়েছিল।
গোরাদার (গোরা সর্বাধিকারী — কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রিয় ছাত্র) তখন সংগীতভবনে অধ্যক্ষের পদ সামলাচ্ছেন। তখন মোহরদি বেশিরভাগ সময় বাড়িতে একাই থাকতেন। প্রায় সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বয়স হয়ে গেলে সবারই কমবেশি এমনটা হয়। মানুষ সঙ্গ চায়। তখন আমি আর রুণুদি বেশিরভাগ সময় কাছে থাকতাম। মোহরদি তখন গানও শেখাতে চাইতেন না। সংগীতভবনে একটা ক্লাস নিতেন। পরে ছাত্রছাত্রীরা তাঁর বাড়ি এসে গান শিখত। কিছুদিন পর তাও বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে আমিই সারাক্ষণ গান শিখছি তাঁর কাছে। ফলে বন্ডিং আরও গভীর হয়। গান শেখাতে শেখাতে গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি প্রায়ই ভাগ করে নিতেন। ব্যক্তিগত জীবন তো বটেই, পেশাগত জীবনেও নানাভাবে পরামর্শ পেয়েছি ওঁর। আমি যে আমি হয়ে ওঠেছি তাঁর পুরো কৃতিত্বই ওঁর। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বলে খুব সোজাসাপটা, নিজের প্রতি সৎ একজন মানুষ ছিলেন।
প্র: এই যে একাকীত্বের কথা বললেন, এই সময় কি রবীন্দ্রনাথকে আলাদাভাবে দেখতেন কণিকা?
রেজওয়ানা: রবীন্দ্রনাথের সব গানই শুনতেন। আসলে খুব ওপেন মাইন্ডেড ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত বাদে হিন্দি গানও শুনতেন। টিভিতে যা চলত সবই।
প্র: রবীন্দ্রনাথের গান শিখতে যে আত্মনিবেদন প্রয়োজন, এখন কি তার বড্ড অভাব?
রেজওয়ানা: (একগাল হেসে) এখন তো সময়টাই পাল্টে গিয়েছে। পৃথিবী পাল্টে গিয়েছে। শুধু গান বলে নয়, আমরা কোনওকিছু অত সময় ও নিষ্ঠা দিয়ে করি না। রান্নার পরিশ্রম না করে অনলাইনে খাবার অর্ডার করি। চিঠি লেখার কষ্ট না করে হোয়াটসঅ্যাপ টেক্সট। আগে শুধু টিভি ছিল, এখন ইউটিউব, ফেসবুক, সোশাল মিডিয়া। সারাক্ষণ স্ক্রোলিং। সময়ের বদলটাও মেনে নিতে হবে। তবে এও ঠিক যে রবীন্দ্রসংগীতের শিকড় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। সময় না দিতে পারলেও এটুকু কিন্তু প্রয়োজন।
প্র: রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয়তা কি কমছে?
রেজওয়ানা: রবীন্দ্রনাথের গানকে আধুনিক গানের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে। তাঁর গানের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে না পারলে অর্ধেকটা সেখানেই হারিয়ে গেল। গানের কথার নান্দনিকতা বুঝতে হবে। ব্যান্ড বা আধুনিক গানে যে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়, সেটায় কিন্তু মানসিক স্থিতি নেই। রবীন্দ্রনাথের গান তেমন নয়। সে গান মনকে স্থিত করে ডুবিয়ে দিচ্ছে গভীরে। রবীন্দ্রসংগীত শুধু শোনার জন্য শোনা নয়। সে গান কারও কারও জীবনের সঙ্কটের সময় ‘প্রয়োজন’ হয়ে ওঠে।
প্র: বাংলাদেশে কি রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা বেশি হয়?
রেজওয়ানা: বাংলাদেশে প্রচুর চর্চা হয়। আসলে বাংলাদেশে বাংলা জাতীয় ভাষা কিন্তু এখানে বাংলা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই সীমিত। ফলে এখানে বেশি চর্চা হবে, আশা করা ঠিক নয়। এখানেই বা কজন নিয়মিত মালয়ালম, তেলেগু গান শোনেন?
প্র: ইউটিউবে ‘টেগোরকভার প্রোডাকশন’-এর গায়ক-গায়িকারা তো আপনারই ছাত্রছাত্রী। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে জনপ্রিয় সব প্রোডাকশন করছে তাঁরা। নিজের ছাত্রছাত্রীদের কাজ কেমন লাগছে?
রেজওয়ানা: ওরা খুবই ট্যালেন্টেড। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সবাই এখন বাইরে চলে গিয়েছে। একজন অস্ট্রেলিয়া, দুইজন কানাডা, একজন ঢাকা, একজন আমেরিকায়। জানি না, আবার কবে নতুন প্রোডাকশন আসবে। আসলে সময়টাও পাল্টে গিয়েছে। শুধু গান করব, আর কিছু করব না, এমনটা এখন আর হয় না।
প্র: নিজের কোনও গান নতুন করে রেকর্ড করার কথা ভাবেন?
রেজওয়ানা: একদম। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। মোহরদির সামনে একবার তাঁর নিজের গাওয়া গান ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে’ চালানো হয়েছিল। ওঁর ১৫-১৬ বছর বয়সের রেকর্ডিং। শোনামাত্রই ‘ইস ছিঃ ছিঃ’ করে বন্ধ করতে বলেছিলেন। স্বাভাবিক, অল্প বয়সের ওই গাওয়া পরে তাঁর ভালো লাগেনি। এমনটা অনেক শিল্পীরই হয়। আমারও হয়।
প্র: রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই তো খুব ব্যক্তিগত! মানে নিরালায় শোনার, উপলব্ধি করার মতো গান। অনেক শিল্পীই প্রচুর মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে গানগুলি রেকর্ড করেন। আপনার কি মনে হয়, ইনস্ট্রুমেন্ট কমিয়ে রেকর্ডিং করলে ভাবটা আরও ব্যক্তিগত হয়?
রেজওয়ানা: এটা আসলে মানুষ অনুযায়ী একেকজনের ভাবনা। কেউ তানপুরা নিয়ে রেকর্ড করছে, তো কেউ ওয়েস্টার্ন ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে। তাছাড়া অনুষ্ঠান হলে সঙ্গে আরও পাঁচজন যন্ত্রসংগীতশিল্পীরা থাকেন। তাদের তো বাজাতে বারণ করা যায় না। তবে একটা সফ্ট গান হলে লাউড মিউজিক বাজাতে বারণ করি। কিছু গানে আমি শুধু হারমোনিয়াম বাজিয়েও গাই। এই ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট সীমারেখা টানা যায় না।
প্র: নতুন প্রজন্ম কী কারণে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে রাখবেন?
রেজওয়ানা: প্রথম কারণ ট্র্যাডিশনাল রেন্ডারিং। দ্বিতীয়ত, খুব পিউর ফর্ম অব রবীন্দ্রসংগীত। আমার মনে হয়, যাঁরা রবীন্দ্রসংগীতের গান শুনবেন তাঁদের কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শুনতে হবে।
প্র: বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে কারা ভালো গাইছে?
রেজওয়ানা: অনেকেই ভালো গাইছে। এই মুহূর্তে নাম বলা মুশকিল। কারওর নাম বাদ পড়ে গেলে বাজে ব্যাপার হবে। তবে এই বৈরীর সময়েও যে গান গাওয়া হচ্ছে, এটাই ভালো লাগে!