রুপোলি পর্দার সূত্রেই শুধু যাঁদের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় তাঁরা হয়ত জানেন না ওঁর প্রথম ভালোবাসার কথা। মঞ্চের প্রতি আজীবন একটা মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ছিলেন সৌমিত্রবাবু। রুপোলি দুনিয়ার হাতছানি কোনওদিনও সেই বন্ধন ছিন্ন করতে পারেনি। কারণ ছোটবেলায় কৃষ্ণনগরে বাবাকে মঞ্চে অভিনয় করতে দেখেই তো অভিনয়ের প্রেমে পড়েছিলেন সৌমিত্র।
শুধু মঞ্চাভিনেতা হিসাবেই নয়, নাট্যটার হিসাবেও সমান সমাদৃত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা মঞ্চ-নাটকে সৌমিত্রর অবদান বিশাল।সিনেমার পরিচালক হিসাবে দর্শক সৌমিত্রকে পায়নি ঠিকই তবে একাধিক নাটকের পরিচালনার দায়িত্বভাবর সামলেছেন সৌমিত্র। প্রয়াত অভিনেতার অভিনয়ের গুরু শিশির কুমার ভাদুড়ি। সৌমিত্র বরাবরই বলতেন, ‘শিশির কুমার ভাদুড়ি আমার গুরু ছিলেন বটে, কিন্তু এক অসম বয়সী সখ্যতা ছিল তাঁর সঙ্গে। নানা বিষয়ে আলোচনা হত শিশির কুমারের সঙ্গে’।
রাজার আসনে বসে তিনি রাজা হননি, আসলে তিনি বাঙালির মনে রাজ করেছেন। শিশির কুমার ভাদুরির সঙ্গে মঞ্চে মাত্র একটি নাটকেই অভিনয় করতে পরেছিলেন সৌমিত্র। ‘প্রফুল্ল’ নাটকে সুরেশের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র।
বিখ্যাত নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তীর আনন্দবাজারের হয়ে লেখা কলমে জানিয়েছেন,' মঞ্চের সৌমিত্র আমাকে বরাবরই বিস্মিত করেছেন। যে সময় আমরা থিয়েটার করতে আসি, তখন সাধারণ রঙ্গালয় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে বর্তমান। সেই সময়ে একটা ধারণা চালু ছিল। সেটা এই যে, সাধারণ রঙ্গালয়ের নাটক যেহেতু আম-দর্শকের জন্য, সেহেতু তার অভিনয় থেকে মঞ্চসজ্জা— সব কিছুতেই একটা চড়া ব্যাপার থাকবে। সৌমিত্রদা সেই ব্যাপারটা জানতেন'।
বহু বিখ্যাত পাশ্চাত্য নাটক বাংলার প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন সৌমিত্র। ‘দ্য মঙ্কিস প’ অবলম্বনে ‘মুখোশ’ সৌমিত্র এক কালজয়ী কাজ। শৈল্পিক সত্ত্বার সঙ্গে আম-জনতাকে তৃপ্ত করার এক জাদু দণ্ড ছিল নাট্যকার সৌমিত্র হাতে। অভিনয়ের স্বাভাবিকত্ব আর মঞ্চ কম্পোজিশনের আধুনিকতা আজীবন বিদ্যমান থেকেছে সৌমিত্রর নাটকে। তাই তো ‘নামজীবন’,‘বিদেহী’, ‘নীলকণ্ঠ’ দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়ত ভিড়। পরবর্তী সময়ে কৌশিক সেনের সঙ্গে জোট বেঁধে ‘স্বপ্নসন্ধানী’ দলের সঙ্গে ‘টিকটিকি’ নাটকে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। যা বাংলা রঙ্গমঞ্চের জন্য একটা না-ভোলা কর্মযজ্ঞ।
মঞ্চ শিল্পের চরম আকালেও তুড়ি মেরে সুপারহিট হয় ‘ফেরা’। ৮৫ বছর বয়সেও মঞ্চে অভিনয় নিয়ে তাঁর উত্সাহে কোনও খামতি ছিল না।
বিভাস চক্রবর্তীর কথায়, ‘অভিনয়ের চাতুরি তথা মুখোশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে চরিত্রের প্রচণ্ড অভিজ্ঞতার মুখকে প্রকট করতে নাটকের যে নির্মম মিতকথন নাট্যকার সৌমিত্র তাঁর নাটকের ভাষায় নিয়ে এসেছেন, তা পুরনো বাংলা নাটকের উচ্চারণ-কথনবহুল নাটকীয়তা থেকে এত দূরই সরে এসেছে যে তার মৌলিকতা নাটকের সূত্র বা উৎসের ‘অমৌলিকতা’কে অবান্তর করে দেয়’। ‘আত্মকথা’, ‘ছাড়িগঙ্গা’, ‘তৃতীয় অঙ্ক-এর মতো নাটকে এই বিষয়টি সুচারুভাবে উপস্থিত করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। থিয়েটারে তাঁর অবদান নিয়ে ব্রাত্য বসু জানালেন- ‘উনি এতকিছু করেছেন, এবার শান্তিতে ঘুমান, আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি'।
মঞ্চে শেক্সপিয়রের কাজকে উপস্থাপন করতে বরাবর উত্সসাহী ছিলেন সৌমিত্র।নাট্য দুনিয়ার মানুষদের কাছে তিনি কোনওদিন ‘স্টার’ সৌমিত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাশের বাড়ির বড়দাদার মতো। তাদের আপনজন।
অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাইরে তিনি একজন কবি, নাট্যকার। বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বারংবার গর্জে উঠেছে তাঁর কলম। অথচ আজ তাঁর শেষযাত্রায় রাজনীতির কোনও রঙ নেই। সব ভুলে এদিন তাঁর শেষযাত্রায় হাঁটলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমান বসুরা। আর মাইকে বাজল- ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। এটাই তো শিল্পী সৌমিত্র সাফল্য, তাঁর প্রাপ্তি, আজ গোটা তিলোত্তমা শুধুই সৌমিত্রর। সৌমিত্র নিজেই বলেছেন, ‘মানুষ হিসাবে আমি র্যাডিক্যাল। এই অনুসন্ধানী মন বারবার প্রশ্ন করে, এতদিন যাঁদের সবকিছু ভালো দেখেছি, তাঁদের সবটাই কি ভালো? যাঁদের খারাপ ভাবতাম, তাঁরা সত্যিই কি এতটা খারাপ? তার উপর দাঁড়িয়েই বারবার বিশ্বাস ভেঙেছে, আবার তার থেকেই জন্ম নিয়েছে এক নতুন বিশ্বাস’।
আজ সৌমিত্র চলে গেলেন অনেকটা দূর.. না ফেরার দেশে। শেষের কবিতার সেই লাইনটা যেন আজ গোটা শহর জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে- ‘বিদায় হে বন্ধু! বিদায়…’।