রণবীর ভট্টাচার্য
সোমবার রবীন্দ্রজয়ন্তী। বিশ্বকবির পরলোকগমনের পর কেটে গিয়েছে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়। ভারত স্বাধীন হয়েছে, বদলেছে বিশ্ব মানচিত্র, আমেরিকা-রাশিয়া-চিন ক্ষমতার অন্দরমহলে চালকের আসনে থাকার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছে। এর পরে এসেছে বিশ্বায়ন, পরমাণু যুদ্ধের চোখরাঙানি দেখানো স্থানীয় যুদ্ধ, কোভিড এবং তার সঙ্গে বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক উত্থান। রবীন্দ্র আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। রবি ঠাকুর রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন, তাঁর জীবনের পরতে পরতে উদাহরণ রয়েছে। প্রথম জীবনে স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিদেশি দ্রব্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন কবিগুরু আবার শেষ জীবনে আন্তর্জাতিক হওয়ার কথা বলেছিলেন। রাজনীতির আঙিনায় রবীন্দ্রদর্শন ব্যক্তিগত উপলব্ধির পরিসর থেকে এসেছিল, তাই পরিবর্তনও হয়েছে কবির নিজের জীবনপটের অভিজ্ঞতায়। বলতে গেলে এক নতুন ধরনের রাজনীতির কথা বলেছিলেন তিনি। অনেকেই অবশ্য সেই রাজনীতির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বারবার উঠে এসেছে সেই প্রসঙ্গ যে কবির আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার সাথে কি তথাকথিত জাতীয়তাবাদের কোনও বিরোধ রয়েছে?
আধুনিক ভারতের অন্যতম স্থপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপীয় রেনেসাঁ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এর সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যের মেলবন্ধন তৈরি করেছে রাজনীতির রবীন্দ্র ভাবনা। তিনি একাধারে জাতীয়তাবাদী আবার আন্তর্জাতিকতাবাদীও বটে। দুই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে তিনি বুঝেছিলেন যে উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা কোথায় পৌঁছে দিতে পারে মানুষকে। তিনি কি কোথাও একক জাতিসত্বার উপর অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন? অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর উপন্যাস, চিঠিতে পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে দুর্বল ভিত্তির উপর দেশ তৈরির সমস্যার কথা। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের ইঙ্গিত রয়েছে তার লেখনীতে। তবে সমস্যা হয়েছে অন্যত্র। বেশ কিছু জায়গায় উনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসিয়েছেন। গঠনমূলক জাতীয়তাবাদের দিকটি কম উঠে এসেছে ওঁর লেখনীতে, বরং উগ্র জাতিয়াবাদের থেকে উত্তরণের কোনও পথ নির্দেশ করে যাননি তিনি। ওঁর রাশিয়ার চিঠিতে দেখা যাবে যে উনি তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার প্রশংসা করেছেন কিন্তু লেনিনের নেতৃত্বে সহিংস বিপ্লবের দিকটি তার পছন্দ ছিল না।
রবি ঠাকুরের আন্তর্জাতিকতাবাদকে সহজ ভাষায় তুলে ধরতে গেলে জাতিগত হিংসা ও বিদ্বেষ বিরোধিতার দিকটি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। অনেকে হয়তো এর সঙ্গে বামপন্থার মিল খুঁজতে পারেন। কিন্তু রবি ঠাকুর নিজেকে বামপন্থায় আবদ্ধ করে রাখতে চাননি। ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে কীভাবে কমিউনিস্টদের সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধের চেহারা ঠিক কী রকম হওয়া উচিত? এই নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই এবং অবশ্যই ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে ওঁর ঘরে বাইরে ও গোরা উপন্যাসের কথা এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে করা উচিত। গোরা যখন নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানতে পারে, গোঁড়া হিন্দু পরিবারের সন্তান নয় সে, বরং একটি স্কটিশ পরিবারের, তখন গোরা সোচ্চারে পালিতা মাকেই ভারতবর্ষ হিসেবে বরং করে নেয়।
বর্তমান পৃথিবীতে এক অস্থির অবস্থা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবস্থা যেন শেষ হওয়ার নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকটি টালমাটাল। এর সাথে আর্থিক ও সামাজিক টানাপোড়েন তৈরি করেছে নতুন সমস্যা। এই অবস্থায় রবি ঠাকুরের রাজনৈতিক ভাবনা নতুন করে ভাবনার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দেয়। জীবদ্দশায় উনি হয়তো নিজের রাজনৈতিক ভাবনার কোন তথাকথিত পরিকাঠামো এঁকে যেতে পারেননি, কিন্তু ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য রসদ দিয়ে গেছেন উত্তর আধুনিক ভাবনার। সেটিই বা কম কি!