সংবাদজগতে প্রায়ই দেখা যায় ‘রেজাল্ট ভালো না করায় আত্মহত্যা’, ‘বাবা-মায়ের বকুনি খেয়ে আত্মহত্যা’র মতো শিরোনাম। ভারতীয় জনসংখ্যার একটা প্রমাণ অংশ জুড়ে রয়েছে শিশু ও কিশোর। ২০২১ সালের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বলছে, মোট আত্মহননকারীর ৭ শতাংশের বয়স ১৮-এর নিচে। ঠিক কোন মানসিক অবস্থা থেকে এই পথ বেছে নেয় ১৮ না-পেরনো কৈশোর? হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ও মনোবিদ ডক্টর নীলাঞ্জনা সান্যাল।
বর্তমানে ইন্ডিয়ান সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নীলাঞ্জনা সান্যালের সঙ্গে আলোচনায় প্রথমেই উঠে এল বয়ঃসন্ধির প্রসঙ্গ। এই বয়সে কি নানারকম চাপে আত্মহননের ঝুঁকি বেশি? ‘ভারতে মোটামুটি ১৩-১৪ বছর বয়স থেকে শুরু হয় বয়ঃসন্ধিক্ষণ। তবে বয়ঃসন্ধির সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতা জড়িয়ে থাকবেই তা নয়। মনস্তত্ত্ব বলে, এই বয়সে ওরা ভীষণ সংবেদনশীল—‘এক্সট্রা সেনসিটিভ’। এই সময় বাইরের বাস্তবতা সম্পর্কে যেমন পূর্ণ ধারণা থাকে না, তেমন নিজের ভিতরের সত্যিটাও অচেনা থাকে। গতকাল ক্লাস টেনের একটি ছেলে আমার কাছে এসেছিল। সে বলছে, ‘জানো আন্টি, আমার আজ একটা মেয়েকে ভালো লাগে তো কাল আরেকটা মেয়েকে। আবার তিনদিন পর অন্য কেউ….’ এই ছেলেটির মনোভাবটাই বয়ঃসন্ধিক্ষণ স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আসলে নিজের কী ভালো লাগছে, কেন টান অনুভব করছে —সেটা এই বয়সে ওরা বুঝতে পারে না। তাই এমন অনুভূতি আসে।’
আত্মহননের বিভিন্ন কারণ নিয়ে কথা বলতে বলতে উঠে আসে নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গ! আরেকটি অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা। ‘কিছুদিন আগেই একটি বাচ্চা আমার কাছে আসে। সে বলছে তাঁর বাবা-মা ঝগড়া করতে করতে ডিভোর্সের কথা তুলেছে। বাবা নাকি বলেছে— ডিভোর্স চাইলে নিয়ে আসো কাগজ। আমি সই করে দেব। তখন ছেলেটি গিয়ে তাঁদের থামায়। বলে— আমার পড়তে অসুবিধা হচ্ছে। তোমরা চুপ করো!’ এর পর আমাকে জিজ্ঞেস করছে— আন্টি, সত্যিই কি বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাবে? তোমার কী মনে হয়? আমি তাহলে কী করে থাকব? আমি তো দুজনকেই ভালোবাসি!’
প্রসঙ্গত, উঠে এল সিঙ্গল পেরেন্টের কথাও। সিঙ্গল পেরেন্ট চাইল্ড হলে কি আত্মহননের ঝুঁকি বেশি? নীলাঞ্জনা জানান,‘ঝুঁকি বেশিই। কারণ এক্ষেত্রে একটা ট্রমা থাকে। দেখা যায়, বাচ্চাটার বর্তমান অভিভাবকের সঙ্গী বা সঙ্গিনী হয়তো মারা গিয়েছে বা ছেড়ে চলে গিয়েছে বা অন্য বিয়ে করেছেন। সেই ব্যথার জায়গাটা থেকেই যায়। এখন, বর্তমান অভিভাবক সন্তানকে ভীষণ যত্ন দিয়ে বড় করতে পারলে আত্মহননের ঝুঁকি কম। না পারলে তা অনেকটাই বেশি। এখানে দুভাবে আত্মহননের মানসিকতা জন্মায়। এক হতে পারে, বাচ্চা ভীষণ বায়না করে। অভিভাবক তা না মেটালেই একটা হুমকি দেয় নিজেকে শেষ করার। ঝোঁকের মাথায় তা করেও ফেলে। আরেকটা দিক হল, নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বোধ করা। ‘আমাকে তো ওরা চায় না’, ‘আমাকে ভালোবাসে না’ — এই ভাবনা থেকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।
বর্তমানে বাবা-মায়ের বিভিন্ন বিষয় চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা কীভাবে প্রভাব ফেলছে বয়সটার উপর? মনোবিদ সে কথাও আনলেন তাঁর আলোচনায়। ‘বাবা-মায়ের উচ্চাকাঙ্খা মেটাতে না পারলেও অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। অনেক বাড়িতেই একাধিক সন্তান থাকে। সেক্ষেত্রে তথাকথিত ‘বেশি ভালো’-এর সঙ্গে তুলনা করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। তথাকথিত ‘কম ভালো’ সন্তানটি নিজেকে ‘নিকৃষ্ট’ মনে করে। এই অবস্থায় অপরাধমনস্কতাও বাড়তে পারে আবার আত্মহত্যার মানসিকতাও আসতে পারে। নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করলে, বাবা-মায়ের জীবনে কলঙ্ক ভাবলে, দ্বিতীয়টি ঘটে। নিজেকে এই দায়ী করা আসলে অবসাদের অঙ্গ। অবসাদই আত্মহত্যার প্রধান কারণ।’
এই প্রসঙ্গে নিজের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতাও ভাগ করে নেন তিনি। ‘দাদা-দিদির সঙ্গে তুলনা করে বলে অনেককে এভাবে অবসাদে ডুবতে দেখেছি। খারাপ রেজাল্ট হবে ভেবেছিল আমাদের এলাকারই এমন এক কিশোরী। তাঁর বাবা বড় পদে কর্মরত ছিলেন। বাবার কার্ড নিয়ে গিয়ে রেললাইনকে বেছে নেয় সে। রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল তাঁকে খারাপ বলার মতো ফলাফল মোটেই হয়নি!’ তবে সবার মধ্যেই এক মানসিকতা কাজ করে না। ‘যাদের কাছে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট, ভবিষ্যতে কী করতে চায়—সেটা জ্ঞাত, সে সহজে এই পথ বেছে নেয় না। যাদের কাছে সেটা নয়, নিজেকে পরিবারে অপাঙক্তেয় মনে করে— তারা আত্মহননের পথে যায়।’
প্রেম ও যৌনতার সঙ্গেও প্রথম পরিচয় এই বয়সেই। প্রেমে ব্যর্থতা কীভাবে আত্মহননের পথে ঠেলে দেয়? নীলাঞ্জনা জানান, ‘সাংঘাতিক অবসাদ আসে। নিজের সম্পর্কে নিজের ধারণা প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। তাঁকে পছন্দ না করে তাঁর বন্ধুকে পছন্দ করলে আরও সঙ্গীন অবস্থা হয়। প্রসঙ্গত, এই ঘটনা ওর সঙ্গে বারবার ঘটলে আত্মহননের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়। তবে আত্মহনন করবেই এমন নিশ্চয়তা নেই। বাচ্চাটার ব্যক্তিত্বের বাঁধুনির উপর নির্ভর করে সে কী করবে।’
মানসিক আশ্রয় এই বয়সে ভীষণ জরুরি। মূলত কিশোর-কিশোরীরা সেই মানসিক আশ্রয়েরই খোঁজ করে। আশ্রয় পাচ্ছে কি না তার উপরেই নির্ভর করে আগামী জীবনের অভিমুখ। মনোবিদের কথায়, ‘মানসিক আশ্রয় পেলে ওরা মনে করে, ওদের জীবনে একটা ভরসার জায়গা রয়েছে। এই ভরসা মানসিক শক্তি জোগায়। অন্যদিকে বাড়িতে বাবা-মা বা অভিভাবক স্থানীয় কারও মধ্যে অশান্তি হলে ওরা মনে করে কোথাও গিয়ে সম্পর্কগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই অবিশ্বাসের সুর জন্মালেই অস্থির বোধ করে ওরা। তাই ব্রোকেন ফ্যামিলি হলে সিংহভাগ সময়ে কিশোর-কিশোরীরা সমস্যায় পড়ে। দুধরনের সমস্যা দেখা যায়। এক ক্ষেত্রে মনোযোগ কমে যায়। চঞ্চলতা বাড়ে। বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি, স্মার্ট হতে গিয়ে অশালীন কথা বলা বেড়ে যায়। আবার অন্যদিকে কেউ কেউ সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেয় নিজেকে। কিছুই বলে না। পড়াও করে না। কী হয়েছে জানাতেও চায় না।’ স্বাভাবিকভাবে পরিস্থিতিটা খুব সঙ্কটজনক।
আলোচনার শেষ প্রান্তে উঠে এল আত্মহননের লক্ষণ নিয়ে কথা। অভিজ্ঞ মনোবিদ জানালেন ‘আত্মহননের মানসিকতা থাকলে অনেক আগে থেকেই কিছু লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে। ঘুম কম হয়, কথা কম বলে, খাওয়া কমিয়ে দেয়, ঘর অন্ধকার করে থাকে, দরজা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়ে ঘরে বসে থাকে। এমন লক্ষণ দেখলেই পরিবারের বড়দের সতর্ক হতে হবে।’
সুইসাইড প্রিভেনশনস ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন: 8047096367
লাইফলাইন ফাউন্ডেশন: 9088030303
আইকল: 9152987821
ওয়ানলাইফ ফাউন্ডেশন: 7893078930
স্যামারিটানস: 8422984528
শুশ্রূষা কাউন্সেলিং: 9422627571
মন টকস: 8686139139
স্নেহ ফাউন্ডেশন: +9144-24640050