বাংলার শাক্ত সম্প্রদায়ের ইতিহাসের সঙ্গে কালীপুজোর আষ্টেপৃষ্টে সম্পর্ক রয়েছে। বহু ধরনের কালীপুজো হয় এই বাংলায়। বাংলার অন্যতম বড় কালীমন্দিরটি দক্ষিণেশ্বরে। সেখানেই তিনটে কালীপুজো খুব বড় করে পালন করা হয়। একটি হল ফলহারিনি কালীপুজো, আর একটি হল কার্তিক মাসের দীপান্বিতা কালি পুজো এবং তৃতীয়টি হল মাঘ চতুর্দশীতে রটন্তী কালীপুজো।
তিনটি কালীপুজোই খুব বড় করে পালন করা হয়। ফলহারিনি কালীপুজো, জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে হয়। দীপান্বিতা কালীপূজো হয় কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে। কিন্তু ব্যাতিক্রম এই রটন্তী কালী পুজো। এটি অমাবস্যায় হয় না। এটি হয় চতুর্দশীতে। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে এই পুজো খুব বড় করে পালন করা হয়।
এদিন দক্ষিণেশ্বরে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। অনেকে আসেন পুণ্য স্নান করতে। কিন্তু এই কালীপুজোর বিশেষত্ব কী? কেন এমন নাম? সেটি জেনে নেওয়া যাক।
রটন্তী কালীপুজোর নামের ব্যাখ্যা
রটন্তী কথার অর্থ হচ্ছে ‘রটে যাওয়া’। রটে যাওয়া এক ঘটনা থেকেই এই নামের উৎপত্তি হয়। আর সেটির সঙ্গে যেমন যোগ রয়েছে শাক্তদের, তেমনই যোগ রয়েছে বৈষ্ণবদেরও। এই পুজোর কাহিনি সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের যেতে হবে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের কাহিনিতে। জেনে নেওয়া যাক সেটি।
রটন্তী কালীপুজোর সঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্ক
কথিত আছে শ্রীরাধা যখন কৃষ্ণের বাঁশি শুনতেন, তখন তিনি আর সংসারে মন দিতে পারতেন না। সমস্ত কিছু ত্যাগ করে তিনি ছুটে যেতেন শ্রীকৃষ্ণের কাছে। শ্রীরাধার শাশুড়ি এবং তার ননদ জটিলা কুটিলা অনেক বার এই ঘটনার সাক্ষী থাকলেও, শ্রীরাধার স্বামী আয়ান ঘোষকে এ কথা বিশ্বাস করাতে পারেননি।
মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথি ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রি। এমন সময় কৃষ্ণের বাঁশি বেজে উঠলে শ্রীরাধা তা উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি বাড়ি ছাড়েন কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তাঁকে হাতেনাতে ধরার জন্য পিছন পিছন যান জটিলা কুটিলা। তাঁরা কুঞ্জ বনে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরাধাকে মিলিত হতে দেখেন। দৃশ্য চাক্ষুষ করে বাড়ি ফিরে এসে আয়ান ঘোষকে সে কথা বলেন। কিন্তু আয়ান ঘোষ বিশ্বাস করেন না।
তখন জুটিলা আর কুটিলা তাঁকে জোর করে সেই কুঞ্জবনে নিয়ে যান। যখন শ্রীরাধা ত্রস্ত, ঠিক সেই সময় তাঁকে অভয় দেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। আয়ান ঘোষ মা কালীর উপাসক ছিলেন। তিনি এসে দেখেন, তাঁর আরাধ্যা মা কালী গাছের তলায় বসে আছেন আর তাঁর চরণ নিজের কোলে রেখে সেবা করছেন শ্রীরাধিকা। এটা দেখে আয়ান ঘোষ খুবই খুশি হন। সে দিন তাঁর প্রথম কালীদর্শন হয়। এই বার্তা আয়ান ঘোষ ছড়িয়ে দিলেন দিকে দিকে। তখন এই কথাটাই রটে গেল যে তিনি কালীর দর্শন পেয়েছেন। কৃষ্ণও এভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মা কালী আর তাঁর মধ্যে কোনও ভেদ নেই। তাই মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীতে বিশেষভাবে কালীপূজার প্রচলন হয়। নাম হয় রটন্তী কালী পুজো।
শাক্ত আর বৈষ্ণবদের মিলনে এই দিনটি একটি বিশেষ দিন হয়ে উঠেছে। এই দিনটি বৈষ্ণবদের কাছেও একটি বিশেষ দিন আর চতুর্দশী তিথি কিন্তু জুড়ে আছে মহাদেবের সঙ্গে। কারণ এই চতুর্দশী তিথিতেই হয় শিবরাত্রি। তাই একই দিনে এক সঙ্গে এই দিন দক্ষিণেশ্বরে পুজো করা হয় রাধা কৃষ্ণ ও ভগবান শিবের।