মোচপোলে বিস্ফোরণের পর থেকে সন্দেহের তালিকায় বড় বড় নাম। অভিযোগ, অধিকাংশই জড়িত তৃণমূলের সঙ্গে। তাদের অনেকেই ফেরার। কিন্তু এবাদুল কেন ফেরার? মোচপোল-কাঠুরিয়া থেকে নারায়ণপুর— প্রশ্ন ছিল, ‘এবাদুলকে চেনেন?’ উত্তর শুধু — ‘ওকে কে না চেনে!’ কে এই এবাদুল? কেন এতটা পরিচিতি? কেনই বা রবিবারের পর থেকে এলাকায় দেখা মিলছে না ওর? কাঠুরিয়া ঘুরতেই আঁচ মিলল সবটার।
(আরও পড়ুন: নারায়ণপুরে বাজির রমরমা, বারুদের ঝুঁকিতে কি বিশ্ববিদ্যালয়ও? কী বলছে কর্তৃপক্ষ)
মোচপোলের ঠিক পাশের গ্রাম কাঠুরিয়া। যেখানে বিষ্ফোরণ হয়, তাঁর ৫০০ মিটারের মধ্যেই কাঠুরিয়া জুনিয়র স্কুল। পাশে কাঠুরিয়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। এই দুই স্কুলের ঠিক পিছনেই এবাদুলের বাড়ি। তিনটে। একটা ছোট কাঁচা বাড়ি, বাকি দুটি সুদৃশ্য মনোহর দোতলা ও তিনতলা উঁচু। চাকচিক্য দেখলে যে কারও চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে। ডিজাইনিং রীতিমতো পাল্লা দেবে শহুরে এলাকার বাড়িকেও। সে বাড়ির গেটেই গত কয়েকদিন ধরে তালা। কেরামতের ঘর সাধারণ টিনের চালের। তাঁর স্ত্রী ছাদ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘বাজির ব্যবসা ওর হলে বাড়ির এই হাল হত? আপনার যুক্তি কী বলে?’ এবাদুলের বাড়ি দেখে বোঝা গেল সেই কথার সত্যতা। মোচপোলের ঘটনায় এখনও নাম জড়ায়নি এই ‘দাদা’র। কিন্তু, একটা ‘কিন্তু’ রয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকটা কারণেই।
(আরও পড়ুন: বাজি ছাড়াও ‘অন্য কাজে’ হাত লাগান মোচপোল-কাঠুরিয়ার মহিলারা! ঝুঁকি বেশি নাকি লাভ)
স্থানীয় একজনের কথায়, কাঁসা পিতলের দোকান এবাদুলের। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নারায়ণপুর মোড়ে সেই দোকান। কিন্তু সে বাড়িতে নেই কেন? এ ব্যাপারে সবার মুখে কুলুপ। আদতে কাঁসা পিতলের দোকান নয়, এবাদুলের ব্যবসা বাজির। নারায়ণপুর-কাজিবাড়ি রুটের এক অটোওয়ালার কথায় এবাদুল ‘বাজির সেলসম্যান’!
কেমন ধরনের সেলসম্যান বোঝা যাবে এক ছোট্ট উদাহরণেই। স্থানীয় আরেকজনের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর জানা গেল,কাঠুরিয়ার সুদৃশ্য বাড়ি দুটো আদতে বাজির গুদাম। প্রমাণ? চলতি বছরের গোড়ায় এই বাড়ি দুটি থেকেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ বাজি। কত টাকার? কম বেশি ৫০ লাখ! দশ চাকার ট্রাক এনে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় সেসব। তাহলে কি মোচপোলের ব্যবসার সঙ্গে এবাদুল কোনওভাবে জড়িত? বারাসত এসডিপিও অনিমেষ রায় বলেন, ‘এখন তো পর পর রেইড হচ্ছে। আপনার থেকে শুনে নিলাম। আমরা দেখছি।’
একবার নয়, এর আগেও রেইড হয়েছে এবাদুলের বাড়িতে। বাজেয়াপ্ত হয়েছে বাজি! সেই ভয়েই কি বাড়ি ছাড়া এবাদুল? বাজি বাইরে পাঠানোই কি তাঁর কাজ? এক স্থানীয়ের কথায়, খুব বেশি দিন হয়নি বাড়ি করেছে। বাজির ব্যবসাই কপাল খুলে দিয়েছিল। কাঁসা পিতলের দোকানে গিয়ে খোঁজ করতে জানা গেল, দোকানটা কিংস্টোন এডুকেশনাল ইন্সটিটিউটের বয়েজ হোস্টেল লাগোয়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব হোস্টেল। তার বাইরের দিকে দোকান। রবিবারের পর থেকে দোকান যে বন্ধ আছে তা নয়। দোকান খোলা হয়, তবে এবাদুল নয়, দোকানের কর্মচারীর উপর এখন সেই দায়িত্ব।
সুদৃশ্য বাড়ির আশপাশ ও পিছনের এলাকা এক এক করে ঘুরে দেখা গেল। তিনতলা বাড়ির পিছনে রাখা আছে বালি ও স্টোন চিপস। বাড়ি ছাড়া আরেকটি ‘জিনিস’ তৈরিতে ঠিক একই কাঁচামাল লাগে! অন্য বাড়িটার পিছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ত্রিপল দিয়ে খড় চাপা দেওয়া। পাশেই একটা মুখ বন্ধ বস্তা পড়ে। ভিতরে কী আছে? বোঝার উপায় নেই।
দোতলা বাড়ির ভিতরটা বাইরে থেকেই দেখা যায়। দুর্দান্ত অন্দরসজ্জা। গেটে একটা ছোট্ট তালা। রাতের দিকে কি আসে এবাদুল? রীতিমতো ভয়ের ছাপ স্থানীয়দের মুখে। এবাদুলের ব্যাপারে সহজে মুখ খুলতে চায় না কেউ। খুললেও গলার আওয়াজ নেমে যায় তলানিতে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলার মাঝেই হঠাৎ এগিয়ে আসেন এক কম বয়সি যুবক। ‘এখানে কেন এসেছেন দাদা? আপনি যা ভাবছেন সেসব কিছু হয় না এখানে।’ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতে হল, ‘আপনার নামটা দাদা?’ পকেটে রাখা ফোন দেখে সন্দেহ করে ফিরে যায় যুবক। খুব বেশি দূর নয়, গলির মুখ পর্যন্ত গিয়ে পিছন ফিরে নজর রাখতে থাকে।
বাড়ি দুটোর লাগোয়া কাঠুরিয়া জুনিয়র স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত বাচ্চারা পড়ে। কাঠুরিয়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আসে একেবারে খুদে খুদে মুখ। কাঠুরিয়া জুনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবাঞ্জন দেবনাথ। চাঁদপাড়ার বাসিন্দা। দশ বছরে এই স্কুলে রয়েছেন। এবাদুলের এই গুদামের ব্যাপারে জানেন কি না প্রশ্ন করতেই বললেন কিছু বলতে পারব না। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের দিদিমণি আঞ্জুরা বিবি থাকেন মোচপোলে। এবাদুলের বাড়িতে রেইড হয়েছে জানেন? — ‘হ্যাঁ।’ এত বাচ্চা, ভয় করে না? পুলিশ বা আইসিডিএস অফিসে বলেছেন? — ‘যখন জানতাম না, তখন তো ভয় করত না। আর যখন বাজি তুলে নিয়ে গিয়েছে, তখন তো নিরাপদেই আছি।’ হাসিমুখেই উত্তর দেন আঞ্জুরা। অর্থাৎ, এভাবেই চলছে কাঠুরিয়ার দুই স্কুল। বারুদের ফাঁদেই কি বাচ্চারা পড়তে আসে রোজ? প্রশ্ন জাগে। পুলিশ বলছে, দেখছি।