করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে দৈনিক সংক্রমণ চার লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু সেই অর্থে আক্রান্ত হননি যৌনকর্মীরা৷ কেন?
সোনাগাছির এই রাস্তাটা সন্ধ্যার দিকে একেবারে অন্য চেহারায় থাকে৷ চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ব্যস্ততা এমনিতেই কলকাতার যে কোনও রাস্তার থেকে বেশি৷ সোনাগাছির মুখে তার উপর জায়গায় জায়গায় জটলা থাকে৷ 'বাবুদের' আগ্রহী দৃষ্টি, যৌনকর্মীদের 'বাবু' ধরার চেষ্টা, আলো-আঁধারি রাস্তায় যেন একটু বেশি গায়ে লাগালাগি৷
সেই রাস্তা দিয়েই সোনাগাছির ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মী (নাম পরিবর্তিত)৷ একের পর এক গলির মুখে ছোটো-ছোটো হেল্পডেস্ক৷ থার্মাল স্ক্যানার নিয়ে বসে আছেন স্বেচ্ছাসেবকরা৷ লক্ষ্মীর মুখে ডাবল মাস্ক, সাংবাদিককেও বাধ্য করেছে ডাবল মাস্ক পরতে৷ কিছুক্ষণ পর পরই পকেট থেকে স্যানিটাইজার বের করে হাতে লাগিয়ে নিচ্ছে৷
স্টোরির স্বার্থে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের অব্যবহৃত পরে সাংবাদিককে যেতে হয়েছিল সোনাগাছি৷ করোনার একেবারে গোড়ায় এই লক্ষ্মীদের নিয়েই স্টোরি করেছিল ডয়চে ভেলে৷ লম্বা লকডাউনে কার্যত অনাহারে দিন কাটছিল লক্ষ্মীদের৷ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরে তাঁরা কেমন আছেন, সেটাই স্টোরির বিষয়৷ এমন সোনাগাছি সাংবাদিক দেখেনি৷ গায়ে গায়ে সোনাগাছি হঠাৎ সতর্ক হয়ে নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছে৷ কেউ কারও কাছে ঘেঁষছেন না৷ জায়গায় জায়গায় হেল্প ডেস্কে থার্মাল স্ক্যানারে মেপে নেওয়া হচ্ছে 'বাবুদের' তাপমাত্রা৷ সামান্য সর্দি-কাশির আভাস পেলেও তাঁকে চলে যেতে বলা হচ্ছে৷ একেকটি ঘরে ঢোকার মুখে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে 'বাবুদের'৷
লক্ষ্মীর বক্তব্য, 'ঘরের ভিতরেও মাস্ক খুলতে দিচ্ছি না আমরা৷ নিজেরাও খুলছি না৷ আগেই এ কথা জানিয়ে দিচ্ছি বাবুদের৷ তাতে পোষালে ভালো, না পোষালে কিছু করার নেই৷' খাতায়-কলমে এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি কলকাতার সোনাগাছি৷ শতক পুরনো এই রিপুমহলে এখন বাস করেন প্রায় সাত হাজার যৌনকর্মী এবং তাঁদের পরিবার৷ এছাড়াও রয়েছে যৌনকর্মীরা৷ যাঁরা সোনাগাছিতে থাকেন না, কিন্তু কাজের সূত্রে আসেন৷ সেই সংখ্যা হিসেব করলে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা ১৫ হাজারের কাছাকাছি৷ আশ্চর্যের বিষয় হল, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সেই সোনাগাছি সামলে ফেলেছে৷ মৃত্যু হয়নি একজনেরও৷ সব মিলিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ শতাংশেরও কম যৌনকর্মী৷ কীভাবে?
কিছুদিন আগে করোনাতেই মৃত্যু হয়েছে বিশিষ্ট চিকিৎসক স্মরণজিৎ জানার৷ দীর্ঘদিন ধরে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি কাজ করেছেন৷ সাংবাদিককে বলছিলেন, 'করোনার প্রথম ঢেউয়ে সম্পূর্ণ লকডাউনে ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল সোনাগাছির যৌনকর্মীদের৷ বোঝা যাচ্ছিল ফের লকডাউন হলে তাঁরা না খেতে পেয়ে মরে যাবেন৷' ফলে টিকা আসার পরেই দ্রুত যৌনকর্মীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ডাক্তারবাবু৷ পাশাপাশি শুরু হয় সচেতনতা শিক্ষা৷
এনজিও দুর্বার ভারতের যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে৷ ঘরে ঘরে সচেতনতামূলক লিফলেট বিলি করতে শুরু করে তারা৷ যৌনকর্মীদের বোঝানো হয়, ব্যবসা করলেও কীভাবে দূরত্বের কথা মাথায় রাখতে হবে৷ মুখ থেকে মাস্ক খোলা যাবে না৷ কীভাবে নিজেদের স্যানিটাইজ করতে হবে৷ এরপরেই গোটা সোনাগাছি জুড়ে বেশ কিছু হেল্প ডেস্ক তৈরি করে দুর্বার৷ 'বাবুদের' পরীক্ষা শুরু হয়৷
দুর্বারের সম্পাদক কাজল বসুর বক্তব্য, 'ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতোই সমস্ত কাজ করেছি আমরা৷ তাতে লাভও হয়েছে৷ যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের কড়া আইসোলেশনে রাখা হয়েছে৷ সোনাগাছির মতো ঘিঞ্জি জায়গায় একবার করোনা ছড়িয়ে গেলে ভয়ংকর ব্যাপার হত৷'
দীর্ঘদিন ধরে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করছেন মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, 'খুব সতর্কভাবে সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ সরকারও খুব সাহায্য করেছে৷ সে কারণেই সময় মতো সকলকে টিকা দেওয়া গিয়েছে৷ ব্যবসা বন্ধ না করেও যে সতর্কতা অবলম্বন করা যায়, সোনাগাছি এবারে তা দেখিয়ে দিয়েছে৷'
শুধু সোনাগাছি নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত যৌনপল্লিতেই একই নিয়ম পালন করেছেন যৌনকর্মীরা৷ ফলও পেয়েছেন৷ তবে বাকি ভারতের চেহারা অবশ্য এক নয়৷ দিল্লিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে ফের কাজ বন্ধ হয়ে যায় যৌনকর্মীদের৷ নিশার (নাম পরিবর্তিত) মতো যৌনকর্মীরা হরিয়ানায় দেশের বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন, যাঁরা বাড়ি ফিরতে পারেননি, তাঁরা পরিচিত 'বাবুদের' বাড়ি গিয়ে অথবা হোটেলে গিয়েছেন৷ যৌনকর্মীর বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দিল্লিতে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা এক এনজিও কর্মী৷ তবে গত এক মাসে দিল্লির যৌনকর্মীদেরও টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে৷ জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে তাঁরা কাজও করতে শুরু করেছেন৷