তৃণমূলের রাজ্য কমিটির বৈঠকের পর থেকেই শুরু হয়েছিল টানাপোড়েন। সেদিন কালীঘাটের বাড়ি থেকে চুপচাপ চলে গিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তারপর থেকেই দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে থাকেন। পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে পড়তে শুরু করল দাদার অনুগামী বলে পোস্টার। এই পোস্টার বয় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই জনসংযোগ যাত্রা শুরু করলেন তিনি। দলের প্রতীক, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ছাড়াই চলছিল একের পর এক সভা, সমাবেশ, র্যালি এবং মানুষের পাশে দাঁড়াতে তুলে দিচ্ছিলেন দান–সামগ্রী। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন গুঞ্জন শুরু হয়েছিল শুভেন্দু গেরুয়া শিবিরে যোগ দেবেন।
এই গুঞ্জন যখন শুরু হল তখন বিভিন্ন সভা–সমাবেশ থেকে তোপ দাগতে শুরু করেছিলেন। কখনও তিনি বলেছেন, আমি প্যারাসুটে উঠিনি, লিফটে নামিনি। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উপরে উঠেছি। আবার কখনও বলেছেন, নন্দীগ্রাম থেকে লড়াই করে এখানে এসেছি। এছাড়া তিনি বলেছিলেন, যাঁরা আজ আমাকে নিয়ে কুৎসা করছেন তাঁরা নিজেদের ইতিহাস ভুলে গিয়েছেন। আমি মানুষের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব। তারপর তাঁকে থামাতে বাড়ি গেলেন ভোট–কৌশলী প্রশান্ত কিশোর। তাঁরই মধ্যস্থতায় তিন সাংসদের সঙ্গে চলে মান ভাঙানোর বৈঠক। এই বৈঠকের পূর্বে অবশ্য সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়া না থাকলে পুরসভার বাইরে আলু বিক্রি করতিস রে আলু।
এই পরিস্থিতির ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামেন তিন সাংসদ। সেখানে শুভেন্দু একটি শর্ত দিয়ে বসেন। যা পৌঁছে যায় তৃণমূলনেত্রীর কাছে। ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়। তখন ১৯ তারিখ যেখানে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বলার কথা ছিল, সেখান থেকে (রামনগর) তিনি বলেন, ‘আমাকে মুখ্যমন্ত্রী দল থেকে তাড়াননি। আমিও দল ছাড়িনি।’ এই কথা বলার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন ওই তিন সাংসদ। কিন্তু সেটা ছিল সাময়িক স্বস্তি। কারণ দীর্ঘ টালবাহানার অবসান ঘটিয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিলেন শুভেন্দু অধিকারী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে পদত্যাগ করলেন তিনি। তাতে তিনি লেখেন, ‘রাজ্যের মানুষের সেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ’। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কেও ইমেলে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তিনি।
তবে এই ঘটনার আগে আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা হল, এইচআরবিসি’র চেয়ারম্যান পদ থেকে তিনি ইস্তফা দিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবারই সেই ঘটনা ঘটে। আর তৎক্ষনাৎ সেখানে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বসিয়ে দেওয়া হয়। একেবারে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ঠিক তার পরেরদিন শুক্রবার রাজ্য সরকারের দেওয়া নিরাপত্তা ছাড়েন শুভেন্দু অধিকারী। নিজের পাইলট কার এবং এসকর্টও ছেড়ে দেন। তাতেই তাঁর পদ্মশিবিরে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আরও জোরালো হল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। স্রেফ পাইলট কারই নয়, শুক্রবার ছেড়ে দিলেন মন্ত্রিত্বও।
সূত্রের খবর, ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই গেরুয়া শিবিরে নাম লেখাতে পারেন রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী। তবে শুভেন্দুর জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও রয়েছে। তা প্রত্যাহার করার জন্য বলা হয়নি বলেই খবর। এমনকী শুক্রবারই হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান পদ থেকেও ইস্তফা দেন শুভেন্দু। গত সাত–আট ধরেই প্রশাসনিক কাজে পরিবহণ ও সেচমন্ত্রী শুভেন্দুর সক্রিয়তা ক্রমান্বয়ে কমছিল। অফিসেও বিশেষ আসছেন না। শেষবার আমফানের পরই কেবল তাঁকে প্রশাসনিক কাজে দিঘা ও সুন্দরবনে যেতে দেখা গিয়েছিল।
তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘শুভেন্দু শহিদের মর্যাদা পেতে চাইছেন। তাই দেখছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বরখাস্ত করেন কি না। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন। তিনি বুঝিয়ে দিতে চান, অন্যায় দাবি মেনে কারও সঙ্গে সমঝোতা করবেন না। আবার কেউ অসন্তোষ প্রকাশ করলেই তাঁকে দল থেকে ছুড়ে ফেলাও তাঁর ভাবনা নয়।’ আসলে শুভেন্দু উপ–মুখ্যমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। যা বিজেপি দিতে রাজি বলে সূত্রের খবর। কিন্তু তৃণমূল দিতে চায়নি। সংঘাত এখানেই।