উত্তরবঙ্গের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা কেন্দ্র হল আলিপুরদুয়ার। প্রথম দফায় ১৯ এপ্রিল এই কেন্দ্রে ভোটদান করা হবে। আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রটি লোকসভা কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৭ সালে। বর্তমানে এই লোকসভা কেন্দ্রটি তফশিলি উপজাতি জন্য সংরক্ষিত। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৬ লক্ষ ১৩ হাজারের অধিক ভোটদাতা রয়েছে এই কেন্দ্রে। আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে ঐতিহাসিকভাবে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আরএসপি) জয়লাভ করে এলেও বর্তমান সময়ে এই কেন্দ্রটি ভারতীয় জনতা পার্টির হাতে রয়েছে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের জন বার্লা এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন। এবার ফিরে দেখা যাক ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচনী ফলাফল। ১৯৭৭ সালে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের পীযূষ তিরকে এই লোকসভা কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেসকে পরাজিত করে প্রথমবার জয়লাভ করে। ১৯৮০ সালেও ফের জাতীয় কংগ্রেসের তুনা ওরাওঁকে পরাজিত করে পীযূষ তিরকে জয়লাভ করেন এই নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে৷
১৯৮৪, ১৯৮৯ এবং ১৯৯১-এর লোকসভা নির্বাচনে জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের পীযূষ তিরকেই জয়লাভ করেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্বিতীয় স্থানে থাকে। ১৯৯৬ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা যায় পীযুষ তিরকে দল পরিবর্তন করলেও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল জয় লাভ করে। জোয়াকিম বাকলা নতুন সাংসদ নির্বাচিত হন এই কেন্দ্র থেকে। ১৯৯৮ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাতীয় কংগ্রেস তাদের জনসমর্থন হারায়। ভারতীয় জনতা পার্টি এই অঞ্চলে নতুন করে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য রাজনীতিতেও বিজেপি রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পায় এই লোকসভা নির্বাচন থেকেই। এর পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে এবং ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীদের হারিয়ে আরএসপি-এর জোয়ামিক বাকলা জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন।
২০০৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের পবনকুমার লাকরাকে হারিয়ে জয়ী হন আরএসপ’র মনোহর তিরকে। উল্লেখযোগ্য ভাবে বিজেপির মনোজ টিগ্গা পান প্রায় দুই লক্ষ ভোট। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের অবসান ঘটে ২০১১ সালে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা যায় আরএসপি’র দীর্ঘদিনের গড় আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস জয়লাভ করে। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী দশরথ তিরকে ১৯ হাজারের কাছাকাছি ভোটে আরএসপি-র মনোহর তিরকেকে পরাজিত করেন। তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপির প্রার্থী বীরেন্দ্র ওঁরাও ২৭.৩০ শতাংশ ভোট পান। ২০১৪ সালে দেখা যায় আরএসপি’র ভোট ১৩ শতাংশ কমেছে, অন্যদিকে বিজেপির ভোট ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ০.৩৫ শতাংশ বেড়েছিল এই নির্বাচনে। ২০১৪ সালে নির্বাচনে দেশ জুড়ে ভারতীয় জনতা পার্টি ভালো ফলাফল করলেও বাংলায় তারা দাগ কাটতে পারেনি। কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে দেখা যায় সারা দেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক পরিসরেও ভারতীয় জনতা পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। ভোট সংখ্যাও ব্যাপক বৃদ্ধি পায় এই নির্বাচনে। বিজেপি’র জন বার্লা ২ লক্ষের অধিক ভোটে পূর্ববর্তী সাংসদ দশরথ তিরকেকে পরাজিত করেন ২০১৯ সালে।
আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র হল তুফানগঞ্জ, কুমারগ্রাম, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, মাদারিহাট ও নাগরাকাটা। এর মধ্যে তুফানগঞ্জ কোচবিহার জেলায়, বাকি ৬ টি বিধানসভা কেন্দ্র আলিপুরদুয়ার জেলাইয় অবস্থিত। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তত উত্তরবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের ভোট শতাংশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বিজেপির পক্ষ থেকে মালতি রাভা রায় তুফানগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ৩০ হাজারের অধিক ভোটে জয়লাভ করেন। তফশিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত কুমারগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির মনোজ কুমার ওরাওঁ ১১ হাজারের কাছাকাছি ভোটে পরাজিত করেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। কালচিনি তপশিলি উপজাতি সংরক্ষিত বিধানসভা কেন্দ্রটিতে বিজেপি’র বিশাল লাভা ২৮ হাজার ভোটে জয়লাভ করেন৷ আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, নাগরাকাটা প্রত্যেকটি আসনেই দেখা যায় বিজেপির জয়-জয়কার। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের প্রতিচ্ছবি ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও পড়ে কিনা, তার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। প্রসঙ্গত আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলি হল চা বাগানের সমস্যা থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের প্রতি ঐতিহাসিক বঞ্চনা ইত্যাদি। এই সকল চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে তৃণমূল কংগ্রেস এই আসনটি ফের বিজেপি’র থেকে ছিনিয়ে নেয় নাকি উত্তরবঙ্গের মাটিতে ফের পদ্ম ফোটাতে পারে বিজেপি, সেদিকে অবশ্যই নজর থাকবে সকলের।
এবারে জন বার্লাকে টিকিট দেয়নি বিজেপি। তাঁর বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ ছিল, ফলে মনোজ টিগ্গাকে এবার বিজেপি প্রার্থী করেছে। এই বর্ষীয়ান নেতা তথা বিধায়কের বিরুদ্ধে তৃণমূল লড়াইয়ে নামিয়েছে প্রকাশ চিক বারাইক। অন্যদিকে আরএসপি-র হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছেন মিলি ওরাওঁ। প্রচারের ময়দানে যুযুধান তিন পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। তবে শেষ হাসি কার কপালে, জানতে অপেক্ষা করবে হবে ৪ জুন অবধি।