গোটা সিনেমা দেখার পর বেশ খানিকক্ষণ পর বন্ধুর ঠেলায় বুঝলাম হল ফাঁকা সিনেমা শেষ, নাম দেখানো। কিন্তু আমার ঘোর এখনও কাটেনি। এটা কী দেখলাম। এটা কোন স্বস্তিকা! এ কোন খরাজ মুখোপাধ্যায়! ‘শিবপুর’ ছবিতে ৮০ এর দশকে সেখানে চলা মাফিয়া রাজের গল্প দেখানো হয়েছে। কিন্তু এ তো সিনেমা বাস্তবে তো নানা সময়ে দেশের নানা প্রান্তে যে মাফিয়া রাজ চলেছে সেটাকেই পর্দায় তুলে নিয়ে এল। কত নিরীহ মানুষ তার শিকার হয়েছে। ধ্বংস হয়ে গিয়েছে কত সংসার এই মাফিয়া রাজের জন্য। সমস্ত ভয়াবহ ছবি এই দুই ঘণ্টায় আপনার চোখের সামনে উঠে আসবে। শিউরে উঠবেন। ভয় পাবেন। ঘেন্না হবে। অথচ চোখ ফেরাতে পারবেন না।
যাক আর প্রাককথন নয়, এবার ছবির বিষয়েই আসি। একজন সাধারণ গৃহবধূর মাফিয়া কুইন হয়ে ওঠার গল্প বলল অরিন্দম ভট্টাচার্যের ‘শিবপুর’। মাফিয়া কুইন মন্দিরা বিশ্বাসের চরিত্রে দেখা মিলল স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর স্বামী, মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। একদিন তাঁরই চোখের সামনে ঘুষ না নেওয়ার কারণে খুন হতে হয় তাঁর স্বামীকে। বারবার অনুরোধ উপরোধের পরেও কমপ্লেইন নেয় না পুলিশ। পুলিশ থেকে রাজনৈতিক দল সবই মাফিয়াদের পকেটে। আর সবাই 'ফ্যামিলি ম্যান' কিনা, তাই কেউ 'রিস্ক' নিতে চান না।
এমন অবস্থায় বরের হত্যার বদলা নিতে মন্দিরা (স্বস্তিকা) দ্বারস্থ হয় ওই অঞ্চলের অন্যতম মাফিয়া তথা মাছের সাপ্লায়ার তপন বারিকের (খরাজ মুখোপাধ্যায়) কাছে। কারণ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চান সে। তাঁর বরকে হত্যা করেছে তপনের বিপক্ষ দলের মাফিয়া তথা জমিদার বংশের 'সুপুত্র' নেপাল ভট্টাচার্য। এরপর কীভাবে মাফিয়া হিসেবে উত্থান হয় মন্দিরার, কীভাবে একটু একটু করে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো করে মাফিয়া রাজ শেষ করেন মন্দিরা এবং দুঁদে পুলিশ অফিসার সুলতান আহমেদ (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) সেটা নিয়েই এই ছবি।
স্টোরি লাইন ভীষণ সোজাসাপটা হলেও প্রতিটা সিন অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে যত্ন নিয়ে বানানো হয়েছে। হিংসা, খুনোখুনি এতটাই ভয়াবহ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে একটা সময় আপনি ভুলতে বাধ্য যে এটা ছবি। এই ছবির স্ক্রিনপ্লে এবং সিনেমাটোগ্রাফির জন্য একটা কুর্নিশ জানাতেই হবে। পরিচালকের সত্যিই তুলনা নেই।
এবার আসি অভিনয়ের কথায়। এই ছবিতে এক অন্য স্বস্তিকাকে আবিষ্কার করবেন। কেন তাঁকে টলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী বলা হয় এটা যেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে। সিনেমা দেখে ফিরেছি বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটেছে। তবুও এখনও চোখ বন্ধ করলে স্বস্তিকার কিছু দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। প্রথমেই বলব প্রথম খুনের পর তাঁর অভিব্যক্তি। ওহ মাই গড! এবং শেষ খুনের ক্ষেত্রে তাঁর বসার ভঙ্গি এবং এক্সপ্রেশন। সিটি মারতে জানলে বিশ্বাস করুন হলে বসে দুটো সিটি মেরে আসতাম।
তবে স্বস্তিকার তুলনায় পরমব্রত এখানে অনেকটাই ফিকে। যে পরমব্রতকে ‘সমান্তরাল’ বা অন্যান্য ছবিতে দেখেছি, সেটার তুলনায় তাঁর অভিনয় সেই মাত্রায় পৌঁছল না। একই জিনিস ঘটল সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও। ‘চেঙ্গিজ’ ছবিতে তাঁকে ভীষণ ভালো লাগলেও এখানে অতটা মনে দাগ কাটতে পারলেন না। তবে এ কথাও ঠিক যে তাঁর চরিত্রের স্কোপ বেশি ছিল না।
রজতাভ আহামরি না হলেও ঠিক আছেন। কিন্তু খরাজ মুখোপাধ্যায়, যেমন কমিক সেন্স তেমনই মারকাটারি চরিত্রে ফাটাফাটি ফিট। ভার্সেটাইল অভিনেতার যোগ্য উদাহরণ তিনি। মাছ সাপ্লায়ার তথা মাফিয়ার চরিত্রে স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গিতে তাঁর লুক একেবারে পারফেক্ট।
তবে এছাড়াও নজর কাড়লেন এই ছবির কানা চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন। বেশ ভালো।
এবার আসি সংলাপে। কিছু নিখাদ নিপাট সত্য সংলাপে বলা হয়েছে। দুটি উদাহরণ দিই, 'মানুষ সম্মান না দিলে আদায় করে নিতে হবে', এবং দুই, 'সকালে মারপিট কিন্তু দিন শেষে সবাই এক গ্লাসের বন্ধু।' শেষ বক্তব্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে।
সবটা মিলিয়ে ফাটাফাটি এক কথায়। বেশ ভালো লাগল অরিন্দম ভট্টাচার্যের এই কাজ। ছবিটাকে নিয়ে শুরুতে অনেক বিতর্ক হলেও এটা একটা অত্যন্ত ভালো কাজ হয়ে থেকে গেল।