ভেবেছিলাম ভয়ের কিছু নেই
তখনও কিন্তু সারা বিশ্বে কোভিড ১৯ নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক শুরু হয়নি। খবর দেখে ভেবেছিলাম করোনার কবলে কেবল চীন, জাপান এবং তার আশেপাশের দেশই পড়েছে। ওসব প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের দেশ, নিশ্চই সামলে নেবে। কোনও ভাবেই রোগ ছড়াতে দেবে না। তাছাড়া সেই সময় থেকেই আমাদের এখানেও সাবধানতা অবলম্বনের প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল, তাই ধরেই নিয়েছিলাম, ভয়ের কিছু নেই, এখানে কিচ্ছু হবে না। আর ইউরোপ নিয়ে তো টেনশনের প্রশ্নই ওঠে না, ওটা সচেতন বিশ্ব! কিন্তু আমার ভাবনা যে এত তাড়াতাড়ি ভুল প্রমাণ হবে সেটা ভাবতে পারিনি! আর আমি কেন, কেউই ভাবতেই পারেনি যে এটা বিশ্বব্যাপি মহমারীর আকার ধারণ করবে এত তাড়াতাড়ি!
জনমানব শূণ্য দুবাই এয়ারপোর্ট
একটা বড় ছবি তাই লোকজন অনেক। বেশ বড় একটা ইউনিট। টিমের বেশিরভাগ লোকজনই আগেই লন্ডন পৌঁছে যায়। আমি আর বিশ্বনাথ ১২ তারিখ ভোর বেলা লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি তখন এবং এয়ারপোর্টের ভেতরেও ওখানকার স্টাফ বা যাত্রীদের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। আর পাঁচটা দিনের মতই সব কিছু ছিল। শুধু এয়ারপোর্টে ঢোকার মুখে একটা পরিবারকে দেখেছিলাম তাঁদের প্রত্যেকের পরনে সারা শরীর ঢাকা পোশাক , মুখে মাস্ক এবং হাতে ইউজ অ্যান্ড থ্রো প্লাস্টিকের গ্লাভস, সেটা সেলোটেপ দিয়ে আটকানো। এছাড়া কয়েক জন বিদেশি এবং আমরা ছাড়া আর কাউকেই মাস্ক বা গ্লাভস ব্যবহার করতে দেখিনি। খুব একটা ভিড় ছিল না এয়ারপোর্টে। ইমিগ্রেশনের ওখানেও ভিড়ভাট্টা ছিল না। ফ্লাইটের ভেতরেও সব কিছু স্বাভাবিক নিয়মেই চলছিল। ছাড়ার সময় খেয়াল করলাম প্লেন ৮০ ভাগ মত ভর্তি। প্রথমে দুবাই পৌঁছলাম। সেখানেই চোখে পড়ল অস্বাভাবিক বিষয়টা। এয়ারপোর্টে একেবারে ফাঁকা! কেবল স্টাফ, আর আমাদের মত কিছু প্যাসেঞ্জর রয়েছে। কয়েকটা দোকান খোলা কিন্তু দোকানে কোনও লোক নেই। আমি এর আগে বহুবার দুবাই এসেছি কিন্তু এমন জন মানব শূণ্য অবস্থা দেখিনি! কিছুক্ষণ পর দেখি একটু দূরে একটা স্ট্রেচারে একজনকে কিছু একটা পরীক্ষা করা হচ্ছে। তখন পিপিই পোশাক সম্বন্ধে আমার ধারণা ছিল না, ওই প্রথম পিপিই পোশাক পরা কাউকে দেখলাম। ওটা দেখার পর কিন্তু একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! যাইহোক, আর তো কিছু করার নেই, আমরা তখন মাঝপথে। আবার জার্নি শুরু।
হিথ্রোতে এই প্রথম
যথা সময় হিথ্রো পৌঁছালাম। এখানে আবার নতুন করে অবাক হওয়ার পালা, এয়ারপোর্ট একটাও লোক নেই! শুধু আমরা যে ক’জন ফ্লাইট থেকে নামলাম তারা এবং স্টাফরা ছাড়া অন্য কেউ নেই। তখন কিন্তু ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়নি, মানুষজন নিজে থেকেই যাতায়াত বন্ধ করতে শুরু করেছে ততদিনে। যাঁদের উপায় নেই, কোনও এমার্জেন্সি রয়েছে এমন হাতে গোনা কয়েকজন প্যাসেঞ্জার মাত্র! হিথ্রো বলে কথা, অথচ একটা টুরিস্ট পর্যন্ত নেই! বাইরে পার্কিং-এ গাড়ি অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। সেটা খুঁজে পেতে অনেকটা সময় লেগেছিল, সেই সময় বাইরেও কোনও লোক চোখে পড়েনি। হয়ত ডোমেস্টিকে লোকজন থাকতে পারে, কিন্তু ইন্টারন্যশেনাল একদম খালি। গাড়ি করে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল যাওয়ার পথে আলাদা করে কিছু বুঝতে পারিনি। রাত হয়ে গিয়েছিল। বেশ ফাঁকা রাস্তাঘাট। রাতের লন্ডন কেমন সেই সম্বন্ধে ধারণা ছিল না।
করোনার জন্য নয়, তখন ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে এন-৯৫
হোটেলে গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা হল, ওরা শুটিংয়ের গল্প করছিল। তখন আবার সব কিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। হোটেলের পরিবেশও বেশ শান্ত। কোনও উত্তেজনা নেই। করোনা সংক্রান্ত কোনও আলোচনাও কোথাও শুনলাম না। পরদিন ভোর থেকেই শুটিং শুরু হল। সেখানেও সব কিছুই স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল। শহরের ভেতরে, বাইরে, কান্ট্রি সাইডে বিভিন্ন লোকেশনে আমারা শুটিং করছিলাম। কোথাও কোনও অসুবিধা হয়নি, মাস্ক বা গ্লাভস পরা কাউকে চোখেও পড়েনি। তবে এটা জেনেছিলাম রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রামে লোক সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম চলছে। আমাদের ইউনিট থেকে অবশ্য এন-৯৫ মাস্ক এবং গ্লাভস ও স্যানিটাইজার সবাইকে দেওয়া হয়েছিল। যদিও ওখানে রাস্তাঘাটে কাউকেই মাস্ক ব্যবহার করতে দেখিনি।অমরা অবশ্য মাঝেমাঝে মাস্ক লাগাচ্ছিলাম, সেটা করোনার জন্য নয়, লন্ডনে অসম্ভব ঠান্ডা তখন, সেই ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করছিলাম।
বেলা ১২টার মধ্যে লন্ডন ছাড়তে হবে
১৬ তারিখ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। ছবির প্রোডিউসার তথা নায়ক জিতদা, পরিচালক অংশুমান প্রত্যুষ, মিমি, বিশ্বনাথ, মিঠুদা, (অভিষেক চ্যাটার্জি) এবং আমি সহ ইউনিটের সবাই মিলে বেশ ভালোই কাজ চলছিল। ১৬ তারিখ শুটিং চলাকালীন একটা চাপা আলোচনা শুনতে পাই যে ১৮ তারিখে দুপুর ১২টার মধ্যে যদি আমরা লন্ডন না ছাড়ি তাহলে আমাদের এখানেই আটকে থেকে যেতে হবে। প্রথমে বিষয়টা পাত্তা দিইনি। কিন্তু শুটিং শেষ করে হোটেলে ফেরার পর ছবিটা স্পষ্ট হয় সকলের কাছে। চারিদিকের খবর শুনে বুঝলাম করোনা তাণ্ডব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। এদিকে আমার ২২ তারিখ পর্যন্ত শুটিং ছিল। আর গান এবং আরও কিছু দৃশ্যের শুটিং শেষ করে পুরো ইউনিটের দেশে ফেরার কথা ছিল ২৯ তারিখ। এত বড় একটা টিম, টানা আউটডোর বিদেশে, এই সবের খরচ আকাশ ছোঁয়া। শুটিং মাঝপথে বন্ধ করে ফিরে এলে অনেক টাকার ক্ষতি। কিন্তু এই খবর শোনার পর জিতদা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনি। তখনই সিদ্ধান্ত নেয় আমাদের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে দেশে ফেরার।এত অল্প সময়ে এত গুলো লোকের টিকিট পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। পৃথিবীর ব্যস্ততম এবং গুরুত্বপূর্ণ এয়ারপোর্ট হিথ্রো। কত কত টুরিস্ট, প্যাসেঞ্জার সকলেই তখন ভিড় জমিয়েছে এয়ারপোর্টে, সকলেই বাড়ি ফিরতে চায়। যাইহোক, অনেক চেষ্টার পর দু’টো ফ্লাইটে ভাগ করে আমরা ফিরে আসি।
হ্যাটস অফ জিতদা
পরদিন এয়ারপোর্টে এসে চমকে গিয়েছিলাম! এটা হিথ্রো নাকি আমাদের হাওড়া স্টেশন! পিলপিল করছে মানুষ। অস্বাভাবিক অবস্থা! ওই দৃশ্য মনে থাকবে সারা জীবন। হ্যাটস অফ জিতদা, এবং তাঁর ইউনিট, ওই সময় এত গুলো লোককে নিয়ে ফেরা মুখের কথা ছিল না। ফেরার পথে প্রথমে দুবাই তে এলাম। দুবাই কিন্তু ফাঁকাই ছিল। সেখান থেকে কলকাতা। কলকাতায় এয়ারপোর্টে আমাদের পরীক্ষা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের সঙ্গে দুবাই থেকে একটা ফ্যামিলি আসছিলেন। ওঁরা আমাদের সঙ্গে ছবি তোলেন, বেশ কাছাকাছি বসেই গল্প করেছিলাম দুবাই এয়ারপোর্টে। কলকাতা এয়ারপোর্টে আমাদের ছেড়ে দিলেও ওই পরিবারটিকে আটকে দেওয়া হয়। ওদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। এটা দেখার পর টেনশনে পড়ে যাই। মাদের সবার টিকিট হয়।
ছোট্ট ছেলেটার জন্য মন কেমন করছিল
কথা ছিল ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আমার স্ত্রী ও পুত্রকে শ্রীরামপুরের বাড়ি থেকে নিয়ে কলকাতায় নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরব। সেটা না করে আমি একাই আমার ফ্ল্যাটে ফিরি। ড্রাইভারকে আমার মালপত্রে হাত দিতে দিইনি। নিজেই সব নামিয়েছি। টানা ১৪দিন নিজেকে ঘরবন্দিকরে রাখি। সেই সময় এলাকায় রটে গিয়েছিল একজন লন্ডন ফেরত করোনা আক্রান্ত অভিনেতা দেশে ফিরে লুকিয়ে রয়েছে! তখন সবে মাত্র লন্ডন ফেরত আমলা পুত্রের ঘটনায় কলকাতা সরগরম। যাই হোক তখন আমাদের সেক্রেটারি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সব রকম সাহায্য করেন। আমি বাড়ি থেকে বের হইনি। ডিরেক্টর অনুপ চক্রবর্তী এবং সেক্রিটারি ওঁরাই আমার বাজার, খাবারদাবার, আর প্রয়োজনীয় সব কিছু দরজায় পৌঁছে দেন। ১৪ দিন শেষ হওয়ার পর যখন বাইরে এলাম ততদিনে লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। আমার ছোট্ট ছেলেটার জন্য মন খারাপ করছিল। প্রায় ৩৫ দিন পর বিশেষ অনুমতি সংগ্রহ করে স্ত্রী এবং সন্তানকে কলকাতায় নিয়ে আসি।
আর্টিস্ট ফোরামকে স্যালুট
এই সময় গোটা পৃথিবী অর্থ সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা শিল্প শ্রমিক। রোজ কাজ করে অর্থ রোজকার করি, কাজ বন্ধ মানেই ইনকাম নেই। এর ফলে প্রচুর আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ান ভাইরা বিপদে পড়েছেন। আবার কবে থেকে কাজ শুরু হবে কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে আর্টিস্ট ফোরাম বিভিন্ন রকম সাহায্য তো করছেই। তাছাড়াও ফোরামের প্রত্যেক সদস্যকে ব্যক্তিগত ভাবে জানানো হয়েছে যে কারও যদি কোনও আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন হয় তাহলে তাঁরা যেন অবিলম্বে আর্টিস্ট ফোরামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফোরাম থেকে সাধ্য মত সাহায্য করা হবে। আর্টিস্ট ফোরামের এই উদ্যোগকে আমি মন থেকে সাধুবাদ জানাই।