'যাহা দিলাম তাহা উড়াড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া তাকাতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে'-এই জীবনদর্শনেই বিশ্বাসী ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। তাই তো আজীবন তিনি তাঁর জ্ঞান আর সৃষ্টি ভাণ্ডার দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন সম্পূর্ন মানবজাতিকে। তবুও এটা বলাই যায় রবীন্দ্রনাথ বাঙালির চিন্তা-চেতনা ও মনন আর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছেন। তাই তাঁকে স্মরণ করবার কোনও বিশেষ দিন হয় না। বাঙালির সুখ-দুঃখ, আবেগ-ভালোবাসা, জীবনের এমন কোনো অনুভূতি নেই যা 'প্রাণের রবি' স্পর্শ করেননি। তাঁর দীর্ঘ বর্ণময় জীবন ছিল বহুমুখী প্রভিতার সমন্বয়। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান ভোলবার নয়। রবি ঠাকুরের লেখা এবং তাঁর সুরারোপিত গানই রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে পরিচিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত মোট গানের সংখ্যা ২২৩২,এই গানগুলি গীতবিতানে সংকলিত হয়েছে। তাঁর গানের কথায় উপনিষদ,সংস্কৃত সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য ও বাউল দর্শনের প্রভাব রয়েছে। তাঁর গানের সুরে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, তরানা, ভজন ইত্যাদি ধারার সুর এবং সেই সঙ্গে বাংলার লোকসংগীত, কীর্তন, রামপ্রসাদী, পাশ্চাত্য ধ্রুপদি সংগীত ও পাশ্চাত্য লোকগীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দশকের পর দশক ধরে বহু সঙ্গীতশিল্পী নিজের জীবন দর্শনের মধ্য দিয়ে,সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুনিয়ার তেমনই
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-
উপমহাদেশের অন্যতম কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি আধুনিক বাংলা গান, চলচ্চিত্রের গান যেমন গেয়েছেন-তেমনই আজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও গেঁথে রয়েছে বাঙালির মনে। বেশ কিছু ছবিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি। জানা যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথমবার রবি ঠাকুরের গান রেকর্ড করেছিলেন ১৯৪২ সালে অপরাধ ছবির জন্য। গানটি ছিল-ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত,‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি। ১৯৪৪ সালে মুক্তি পায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বেসিক রেকর্ডের রবীন্দ্রসঙ্গীত।গান দুটি ছিল- ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ ও ‘আমার আর হবে না দেরি’।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-
রবীন্দ্রসঙ্গীতের যথার্থ সুর এবং ঘরানাকে গায়কির মধ্য দিয়ে আজীবন তুলে ধরেছেন যে ক’জন শিল্পী তাঁর মধ্যে অন্যতম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।স্বয়ং কবিগুরুর শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।জীবনের অধিকাংশ সময়ই শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম অণিমা থেকে কণিকা রেখেছিলেন।জানা যায়,১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথের কলকাতার ছায়া সিনেমাহলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। পরের বছর হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়- ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’ এবং ‘না না না ডাকব না,ডাকব না’। এই গান শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। এরপর আজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা চালিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী।
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়-
রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। আজীবন রবীন্দ্র সাধনার মধ্যেই অতিবাহিত করেছেন এই শিল্পী। জানা যায়-দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড করা ১৫০০ গানের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংখ্যা ৮০০-র বেশি। ১৯৫১ সালে তার প্রথম রেকর্ড করা গান ছিল, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী'।
সুচিত্রা মিত্র-
রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক প্রথিতযশা শিল্পী তথা বিশেষজ্ঞ সুচিত্রা মিত্র। দীর্ঘকাল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি। মেয়েবেলায় পঙ্কজকুমার মল্লিকের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে তিনি এই গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরবর্তী সময়ে কবিগুরুর সাহচর্য লাভ করেছিলেন সুচিত্রা মিত্র। ১৯৪৫-এ প্রথম শিল্পীর প্রথম গানের রেকর্ডে যে দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল তা হল-‘মরণেরে তুঁ হু মম শ্যাম সমান’, এবং ‘হৃদয়ের একুল ওকুল দু’কুল ভেসে যায়’। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়-
রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সর্বকালের সেরা শিল্পীদের মধ্যে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের নাম থাকে একদম প্রথম সারিতে। তিনি দেড়শোর উপরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেছেন। চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের গানের স্টাইল ছিল অনন্য। তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে রাবীন্দ্রিক ভাব, গায়কী, স্পষ্ট উচ্চারণ এবং স্বরলিপির নিখুঁত ব্যবহারের জন্য তিনি অনন্য।