ছোট শহর জলপাইগুড়ির মেয়ে তিনি। আর পাঁচজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের মতোই তাঁর বেড়ে ওঠা। পরিবার, পাড়া, গতে বাঁধা চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে লড়াই করে আজ সেই মেয়েটিই বাংলার পরিচিত মুখ, জনপ্রিয় অভিনেত্রী। আবার কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাংসদও ছিলেন। নিশ্চয় তাঁকে চেনার জন্য আজ এইটুকু বর্ণনাই ‘কাফি’। হ্য়াঁ, ঠিকই ধরেছেন। তিনি আর কেউ নন মিমি চক্রবর্তী।
সেই লড়াইয়ের কথা নিজের কলমে আনন্দবাজারে লিখেছেন মিমি। লিখেছেম, যে জলপাইগুড়িতে তিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, সেখানকার মানুষের চিন্তভাবনা ১০-৫টার চাকরি আর ভাত ঘুমেই আটকে। তবে ছোট থেকেই গতে বাঁধা জীবন পছন্দ ছিল না তাঁর। তাঁর দিদি যখন পড়াশোনায় ভালো ছাত্রী, সঙ্গে ভালো গানও করেন, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত। তখন মিমির পছন্দ ছিল গায়ের রং পুড়িয়ে কবাডি, ব্যাডমিন্টন খেলা, শুধু খেলা নয়, পুরস্কারও জিতেছেন। তবে মিমির আফসোস, ‘কেউ আসে না আমার খেলা দেখতে, জয় দেখতে, বাবাও না, মাও না। তাঁদের সব চিন্তার কারণ আমি। বড়দের কথা শুনি না, হাফ প্যান্ট পরি।’
এর সঙ্গে লেগেই থাকত, পাড়ার লোকজনের কান ভাঙানি। লোকে যেমনটা বলে থাকে আরকি। মিমির ক্ষেত্রেও তাঁর অন্যথা হয়নি। মিমি লিখেছেন, এসবের মাঝেই তাঁর প্রথম মেডেলগুলি হয়তবা হারিয়ে গিয়েছে। খেলা-ধুলোয় তাঁর প্রথম হওয়ার মেডেল যদি তিনি এখন খুঁজতেও বসেন, হয়ত পাবেন না। সেসবই হারিয়ে গিয়েছে কোথাও কোনওখানে।
মিমি লিখেছেন, এই লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গে একা লাগত, তখন তাঁর পাশে একমাত্র যিনি ছিলেন, তিনি ঈশ্বর। মিমির কথায়, শুধু ঈশ্বরেই ভরসা ছিল তাঁর। লিখেছেন তাঁর বড়পিসির মেয়ের বিয়েতেই প্রথম দেখেছিলেন তিলোত্তমা কলকাতাকে। তখন থেকেই জেদ ধরেছিলেন, এই শহরেই একদিন থাকবেন, পড়াশোনা করবেন। নাহ এক্ষেত্রেও বাবা-মা বা পরিবারের লোকজনকে পাশে পাননি তিনি। তাঁর মা-ই তাঁকে বলেছিলেন, জলপাইগুড়ির কলেজে পড়তেও রিকশাভাড়া লাগবে। সেটা নিয়েই তিনি চিন্তা করছেন, এদিকে তাঁর মেয়ে কিনা বলছেন কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা! মিমির বায়নার সঙ্গে এক্কেবারেই সহমত ছিলেন না তাঁর মা। এর উপর পাড়ার লোকজনের টিপ্পনি লেগেই থাকত।
তবে মিমিও কম যান না, স্বপ্নপূরণে তাঁর জেদ কিছু কম ছিল না। মিমির কথায়, ‘দুদিন খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম, বাড়ির লোক বাধ্য হয়েছিল।’ তবে তারপরেও শর্ত ছিল পিসির বাড়ির কাছের কোনও কলেজেই ভর্তি হতে হবে তাঁকে। মিমির কথায়, ‘মেয়েদের ক্ষেত্রে আসলে কোনও কিছুই সহজ হয় না।’
তারপর একদিন সেই মেয়েই নামী অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন। তবে শহরে এসেও তাঁর লড়াই শেষ হয়নি। মিমির কথায় লোকে বলেছিল ‘গ্রামের মেয়ে, কোনওদিনও অভিনয় হবে না। আজ সেই মুখগুলো দেখি না।’ মিমির প্রশ্ন, তাঁঁর যা কিছু লড়াইয়ের পথ মেয়ে বলেই কি মেনে নিতে হবে! নাহ, তিনি সাফ জানিয়েছেন, ‘আমি মানি না…’। তবে এত লড়াইয়ের পরও মিমির আফসোস সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় আজও তাঁকে প্রশ্ন করা হয় মিমির কবে বিয়ে হবে?
তবে সব শেষে মিমি জানিয়েছেন, তাঁর কাছে বাবা-মায়ের পরে আর কেউ নেই। তাঁর কথায়, ‘জীবন একার এ আমার অভিযোগ নয়, এ আমার শান্তির।’