রূপম ইসলাম, এই নামটা শুনলেই প্রথমে যে শব্দগুলি আমাদের মাথায় আসে সেগুলি হল 'রক গান', ‘ফসিল্স’। তবে এই সবকিছুর পরেও আজ তাঁর জন্মদিন। ২৫ জানুয়ারি ৪৯ পার করে ৫০-এ পা দিলেন রূপম। তার আগে Hindustan Times Bangla-র সঙ্গে বেশকিছু কথা ভাগ করে নিলেন রূপম।
৪৯ পার করে ৫০এ পা রাখছেন, জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা রইল। জন্মদিন আর জীবনের এই নতুন বছরটা কীভাবে উদযাপন করতে চান?
রূপম: আমার জন্মদিন আর আমার সম্পত্তি নয়। বেশকিছু বছর হল এই দিনটিতে মানুষের ভালোবাসার যে আলোড়ন দেখি, তাতে আমি আপ্লুত হই। যথাসম্ভব তাঁদের ইচ্ছেগুলো পূর্ণ করার চেষ্টা করি। এর ফলে কতবার যে কেক কাটতে হয়, তার কোনও হিসেব নেই। প্রত্যেকটা কেক যাঁরা যত্ন করে, কষ্ট করে তৈরি করে আনেন বা উৎসবের আবহ তৈরি করেন, তাঁদের সকলকে আমি অন্তর থেকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দিতে চাই। প্রত্যেকটি জমায়েত আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, এই মানুষগুলো আমার জন্য খুব জরুরী।
এইদিন অনেকেই রক্তদান শিবির করেন, আগামিকালও এরাজ্যের ৪টি জায়গায় রক্তদান শিবির হচ্ছে। এগুলি খুবই ‘জরুরী কাজ’। আমার জন্মদিনের অনুসঙ্গে মানুষ যদি এটা করে থাকেন, এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে! যাঁরা এতকিছু করে আমার জন্মদিন মনে রাখতে চাইছেন, সেতুবন্ধন করতে চাইছেন, সমাজের ভালো কাজে নিজেকে লাগাতে চাইছেন, তাঁদের প্রতি আমি আমার শ্রদ্ধাটুকুই রাখতে চাই।
২৫ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার আলাদা করে আর কোনও সেলিব্রেশন কি হচ্ছে?
রূপম: আমার ম্যানেজমেন্ট এখন যাঁরা করেন, সেই 'ট্যালেন্টওয়ালা' সন্ধেবেলা একটা পার্টির আয়োজন করেছে। যেহেতু এটা আমার ৫০তম জন্মদিন। তাঁরা ইতিমধ্যেই সেই আয়োজন করে ফেলেছেন, তাই আমি আমার বিশিষ্ট বন্ধুদের খবর দিয়েছি। এটা আগামিকাল আমার একটা বিশেষ কাজ। আশা করব, এর পরের বছরগুলোতে এটা আর হবে না। আমার জন্মদিন ঘিরে এতটাও বেশিকিছু হোক, সেটা আমি চাই না। তবে ৫০তম জন্মদিন বলে ট্যালেন্টওয়ালা এটা করছে, তাই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। (হাসি)
জন্মদিনে নিশ্চয় অনেক উপহার আসে, সেই অনুভূতিটা ঠিক কেমন?
রূপম: অবশ্যই জন্মদিনে উপহার পাই। এত মানুষ দেখা করতে আসেন, অনেকেই হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। অনেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই আমায় দিয়েছেন। যেগুলি আমার কাজে লাগে, অনেকে সাজানোর জিনিস দেন, সেগুলিও সসম্মানে আমি রাখি। অনেকে ছবি একেঁ দেন, অনেকে ছবি বাঁধিয়ে দেন, সেগুলিও যতটা সম্ভব সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আর সবথেকে বড় উপহার মানুষের ভালোবাসা, সেটা আমি আমার হৃদয়ে রাখি।
আপনিই একসময় ‘বাংলা রক গান’-এর এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও এধরনের গানের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে কী বলবেন?
রূপম: বাংলা রক শুধু তো একটা গান নয়, এটা একটা জীবনদর্শন। এই রক সঙ্গীত যাঁরা শুনছেন, তাঁদের চলার পথে এটা পাথেয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক তেমনই আরেকটা বিষয়ও চলে আসে বাংলা রকের সঙ্গে, সেটা হল 'কনসার্ট'। এই ‘কনসার্ট সংস্কৃতি’ হল মানুষের মিলনক্ষেত্র, যেখানে বাংলা রকের যাঁরা শ্রোতা-দর্শক আসেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান হয়। আমি বলব, আমার কনসার্টগুলি একটা অছিলা মাত্র। তাঁরা নিজেরা আসেন, নিজেরা দেখা করেন, নিজেরা একসঙ্গে গান করেন, উদযাপন করেন। কোনও সময় দিয়ে এটাকে বেঁধে রাখা যাবে না। এটা একসময় শুরু হয়েছিল, তারপর এটা চলছে, নিরন্তর…। আমি আশা করব, যতদিন আমি গান গাইব বা আমার গান নিয়ে কনসার্ট হবে, ততদিন বাংলা রকের শ্রোতা-অনুরাগীদের এই মিলনক্ষেত্রটা বজায় থাকবে। এঁদের আমি ‘বাংলা রক জনতা’ বলি, আমি দেখব ধীরে ধীরে তাঁদের সংখ্যা বাড়ছে, উন্মাদনা বাড়ছে, এটাই তো হয়ে আসতে দেখেছি। এর দুটো কারণ, আমি নিয়মিত কাজ করে চলেছি। আমি এবং আমার ব্যান্ডের সহকর্মীরা একযোগে নতুন গান তৈরি করে চলেছি। কিছুদিন পরপরই আমাদের গানের নতুন অ্যালবাম বের হয়। এবছরও ৬-৭টি গানের নতুন অ্যালবাম বের হচ্ছে, যার নাম ‘ফসিল্স 7’। এই অ্যালবামের কিছু গান আমরা মঞ্চে গেয়েছি, কিছু গান আমার একক অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছে। সেসব গান ইতিমধ্যেই মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।
আরও একটা কারণ হল আমাদের ‘কনসার্ট’ যদি কেউ ১৫ বছর আগে দেখে থাকেন এবং এখন এসে দেখেন, তাঁদের রিভিউ আমি পড়েছি। তাঁরা রীতিমত চমকে যাচ্ছেন, ভাবছেন সবকিছু মিলিয়ে উপস্থাপনায় এত উন্নতি! এই যে উন্নতিটা হচ্ছে, সেটা সারা বিশ্বের কনসার্ট সংস্কৃতির সঙ্গে কোয়ালিটির জায়গাটাতে কোনও আপোস না করে, একই পন্থার পথিক হয়ে। সারা বিশ্বে যেভাবে কনসার্ট সংস্কৃতি উন্নত হচ্ছে, আমরাও চেষ্টা করেছি কোনও প্রোডাকশন— লাইট, সাউন্ড, মঞ্চ এবং পারফরম্যান্স, কোনও জায়গায় কোনওরকম ফাঁক না রাখতে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের সম-মানের অনুষ্ঠান আমরা বাংলার মানুষকে দিচ্ছি। যাঁর জন্য শুধু এই বাংলায় নয়, বাংলাদেশেও যখন আমরা পারফর্ম করতে গিয়েছি, মানুষের উন্মাদনা হয়েছে দেখার মতো। মানুষ যা দেখলেন, তা তাঁরা ভুলতে পারেননি। তাই বারবার তাঁরা ছুটে এসেছেন। দু'মাস জুড়ে আমাদের ১৭-১৮টি অনুষ্ঠান হল, আমরা দেখেছি প্রত্যেক অনুষ্ঠানে মানুষের ভিড়ে পা রাখবার জায়গা নেই। প্রাঙ্গনে যত মানুষ, তার বাইরে আরও বেশি মানুষ বহু জায়গায় রয়েছেন। দুঃখজনকভাবে লাঠিচার্জের ঘটনাও ঘটেছে। এত মানুষ, যে প্রশাসনও ঠিক করে সামলাতে পারছেন না। কারণ, যে বিনোদন আমরা দিচ্ছি, সেটায় জীবনদর্শন মিশে আছে। মানুষকে তা স্পর্শ করেছে।
সম্প্রতি রাজা চন্দের সঙ্গে মিলে 'পুরনো গিটার' নামে একটা মিউজিক ভিডিয়ো আসছে। রাজা চন্দের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
রূপম: ভীষণই সুন্দর অভিজ্ঞতা। রাজা চন্দ এমন একজন পরিচালক, যিনি পুরো পরিচালনার ডিপার্টমেন্ট নিজের হাতে কনট্রোল করেন। এমনটা আমি খুব কম দেখেছি। প্রতিটি বিষয় তাঁর নখ-দর্পনে। যা শ্যুটিংয়ের আগে বলেছেন, একদম সেটাই করেছেন। একচুলও এদিক-ওদিক হয়নি। শেষপর্যন্ত প্রোডাক্ট অর্থাৎ মিউজিক ভিডিয়ো, যেটা তৈরি করেছেন, সেটা খুবই উন্নতমানের। সবথেকে বড়কথা হল, সমস্ত শ্যুটিংয়ে সাধারণত দেরি হয়। এই শ্যুটিংয়ে না শুরু হতে দেরি হয়েছে, না শেষ হতে দেরি হয়েছে। একদম ঘড়ির কাঁটা মেপে যে সময় শুরু করবেন বলেছিলেন, তখনই হয়েছে। যখন আমায় ছাড়বার কথা তখনই ছেড়েছেন। অথচ কিছু বাদ পড়ে যায়নি। যা যা শট উনি ভেবেছিলেন, নিয়েছেন। এটা কিন্তু অনেক বড় গুণ, যেটা পরিচালকের উপরই নির্ভর করে, রাজা সেটা করে দেখিয়েছে। ভিডিয়ো গানটি যদি মানুষের ভালো লাগে, তাহলে আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে। পাশাপাশি আমি বলতে চাই গীতিকার, সুরকার বিশ্ব রায়ের কথা। উনি একজন পুলিশ অফিসার, কলকাতা পুলিশের DCP। তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি, সঙ্গীতেও তিনি এতটা মন দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। শুধু আমি নয়, আরও অনেক শিল্পী তাঁর কম্পোজিশনে গান গেয়েছেন, যা আমি শুনেছি এবং মানুষও শুনবেন। এইরকম একটা দায়িত্বশীল পেশায় থাকা সত্ত্বেয় উনি যে এত ভালোবেসে মিউজিক করছেন এটা সত্যিই প্রশংসনীয়।
বহু ছবিতে গান গেয়েছেন, আবার আলাদা করে 'ফসিল্স'-এর জন্যও গান লিখেছেন, গেয়েছেন, কোনটা বেশি আনন্দ দেয়?
রূপম: দুটোই আমার কাজ। ফসিল্স-এর জন্য, আমার নিজের সোলো প্রোজেক্টের জন্য গান তৈরি করা এবং প্লে-ব্যাক করা বা সিনেমার মিউজিক করা, সবগুলো কাজই আমি করতে ভীষণ ভালোবাসি। গান তৈরি করা শুধু নয়, পারফর্মও তো করি,ফসিল্স-এর মঞ্চে গান গাই, একক মঞ্চেও আমি গান গাই। প্রয়োজন পড়লে সিনেমার গানও কোনও কোনও মঞ্চে গাইতে হয় বৈকি। কোনও কাজই বেশি ভালো, কোনওটা কম ভালো আমি বলব না। প্রত্যেক কাজেই একইরকম সুখানুভূতি হয়।
অরিজিৎ সিং-এর সঙ্গে মিলে প্রোজেক্ট আসার কথা শোনা যাচ্ছিল, সেটা কতদূর?
রূপম: অরিজিতের সঙ্গে আমি একটা নয়, দুটো প্রোজেক্টের কথা বলেছিলাম। দুটোর মধ্যে একটার কথা এগিয়েছে। অন্য প্রোজেক্টের কথা এখনও এগোয়নি। যেটার কথা এগিয়েছে, সেটা ভীষণই সাম্প্রতিক, আজই এটা বলতে পারছি, যে কাজ একটু এগোলো। অরিজিৎ কয়েকটা গান আমায় জানিয়েছেন, যেগুলো নিয়ে উনি আমার সঙ্গে কাজ করতে চান। এবার বল আমার কোর্টে, আমাকে দেখতে হবে অরিজিতের সঙ্গে কোন গানটা নিয়ে আমি কাজ করব। আমি ফাইনাল করলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। এর আগে আমার তরফে অরিজিৎকে কাজ পাঠানো ছিল, ওর সময় হয়নি এতদিন, এবার ওঁর সময় হয়েছে, দ্বিতীয় পর্বে আমরা পৌঁছেছি। আমার কাছে আবারও বিষয়টা ফেরত এসেছে, এবার আমাকে একটা ফাইনাল করে, গান বেছে নিতে হবে।
নতুন আর কী প্রজেক্ট আসছে, অনুরাগীদের জন্য সেগুলি যদি শেয়ার করতেন…
রূপম: নতুন প্রোজেক্টে আমার দু’হাত ভর্তি। এই বছরটা খুবই ইভেন্টফুল একটা বছর হতে চলেছে। ফসিল্স-এর অ্যালবাম, অরিজিতের সঙ্গে প্রোজেক্টটাও এবছর হতে পারে। প্লে-ব্যাক তো অনেক আসবেই, ওটা নিয়ে আলাদা করে তাই বলছি না। আরও একটা মিউজিক ভিডিয়ো 'আবার অরণ্যে' র ঘোষণা আজ, ২৫ জানুয়ারিই হবে। এটা সঙ্গীত পরিচালক সৌম ঋতের সঙ্গে। এছাড়া একটা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে আমি কাজ করছি, যেটার প্রযোজক ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও পরিচালক চৈতি ঘোষাল। ছবির নাম— নেভারমাইন্ড।
ব্রহ্ম ঠাকুরকে নিয়ে ফের উপন্যাসও তো লিখছেন…
রূপম: আনন্দমেলায় একটা উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে, আমার তৈরি করা চরিত্র ‘ব্রহ্ম ঠাকুর’, যাঁকে নিয়ে আমি উপন্যাস লিখে থাকি, অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ। তারই একটা অ্যাডভেঞ্চার প্রকাশিত হচ্ছে। আমি ব্রহ্ম অনুরাগীদের জানাতে চাই, ব্রহ্ম ঠাকুরের যে পূর্ববর্তী উপন্যাস, যেটা এখনও বই আকারে আসেনি, সেটা এবছরই আসবে, নাম ‘শব্দ ব্রহ্ম দ্রুম’। এটা আসছে, পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত আকারে। এর আগে যা প্রকাশিত হয়েছে, তারপর আমি আরও সেটার পরিমার্জন করেছি। বর্ধিত আকারে সেটা আসছে। এছাড়াও ব্রহ্ম ঠাকুরের নতুন উপন্যাস, কাশ্মীরের পটভূমিকায় আসছে, নাম এখনই বলছি না। তবে সেটা বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর। আমার লেখাও হয়ে গিয়েছে। এছাড়া বই হিসাবে তৈরি হয়ে গিয়েছে গান সমগ্র ২, সেটাও এবছরের শেষের দিকে আসছে।
'তীরে এসো সাহসিনী' নামে আপনার প্রথম কবিতার বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, কবি হিসাবে কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?
রূপম: কবি হিসাবে, আমার প্রথম কবিতার বই থেকে যেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছি তাতে আমি খুবই আপ্লুত। বিশেষ করে এই বইটার প্রথম কপি আমি জয় গোস্বামীর হাতে তুলে দিতে গিয়েছিলাম। উনি আমার কাছে দাবি করেছেন, প্রত্যেক ২-৩ বছর অন্তর উনি আমার কবিতার বই হাতে পেতে চান। বলেছেন, ‘আমি বেঁচে থাকব, এটা আপনি করছেন কিনা, সেটা দেখবার জন্য’। এর থেকে বড় কমপ্লিমেন্ট আর কীই বা হতে পারে। এটা আমার নতুন কাজে তাঁর আশীর্বাদ হিসাবেই আমি গ্রহণ করেছি। উনি যখন বলেছেন, তাহলে কবিতা লেখাটাও আমার চলবে। মনের মধ্যে কথোপকথন আমার চলতেই থাকে, সেগুলি লিখিনি এতদিন, এবার লিখব…
'