গীতবিতানের সব গান রেকর্ড করে রবীন্দ্রসংগীতের জগতে ইতিহাস গড়েছেন। কোভিডের সময় রোজ রাতে একটি করে গান রেকর্ড করতেন নিজেই। আবার প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে নিয়ে লিখেছেন কবিতাও। সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে আয়োজিত হয়েছিল কণিকা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান। তার ফাঁকেই হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে কথা বললেন স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত।
প্র: রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চর্চা কোন বয়সে শুরু?
স্বাগতালক্ষ্মী: রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় জন্ম থেকেই। মা সুব্রতা দাশগুপ্ত ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্রী। বাবা পবিত্র দাশগুপ্ত লখনউয়ের ভাতখণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক ছিলেন। ফলে ঘরে ছোট থেকেই গানের পরিবেশ।
প্র: গায়িকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের সঙ্গে প্রথম আলাপের গল্পটা যদি শোনান…
স্বাগতালক্ষ্মী: রবীন্দ্রনাথের গান মানেই আমার কাছে মোহরদি। মোহরদির গান দিয়ে তাঁকে ভালোবেসেছি। আমি ক্লাসিকাল ঘরের মেয়ে। ছোটবেলায় বাবাকে বলতাম, শান্তিনিকেতনে ভর্তি করে দাও। ওখানে গান শিখব, মোহরদিকে দেখতে পাব। তাঁকে দেখার জন্যই শান্তিনিকেতনে গান শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তবে সেট আর হয়নি। দিল্লিতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টান্সি পড়তে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু গানের টানে সে পড়াও মাঝপথে থামিয়ে দিই। রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হই। রবীন্দ্রসংগীত যাতে ঠিকভাবে শিখতে পারি। তাছাড়া আরেকটা উদ্দেশ্যও ছিল। তখন ২৫ বৈশাখসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মোহরদি ওখানে এসে অনুষ্ঠান করতেন। তাঁকে কাছ থেকে দেখতে পাব সে আশাও ছিল।
আমার মনে আছে, ওঁকে প্রথম যেদিন মঞ্চে দেখি, সেদিন আমি একদম প্রথম সারিতে। চেষ্টা করছিলাম, যতটা কাছ থেকে ওঁকে দেখা যায়। উনি ডানহাতে খাতা ধরে বাঁহাত কানে দিয়ে গান শুরু করলেন। ‘আবার যদি ইচ্ছা কর, আবার আস ফিরে’। আমার দেখা ওঁর প্রথম লাইভ পারফরম্যান্স এটাই। আমার দু’চোখে তখন অপরিসীম মুগ্ধতা। এই যে আমি আজ বাটিক পরেছি। আমার এত বাটিক ভালোবাসার কারণও কিন্তু মোহরদি। দারুণ সব আলপনা বাটিক পরতেন তিনি। আমার শাড়ির পছন্দ-অপছন্দের অনেকটা ওঁর থেকে অনুপ্রাণিত।
প্র: আজ যে কবিতাটা পড়লেন, সেটি ২৫ বছর আগে তাঁকে শোনানোর সময় কী প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন?
স্বাগতালক্ষ্মী: সেটা ১৯৯৮ সাল। কোনও এক বর্ষার বিকেলে মোহরদির কাছে বসে তাঁকে শুনিয়েছিলাম। আমার এই কবিতাটার শেষ লাইন হল - ‘আমার ফেলে আসা কৈশোরের তরফ থেকে/ এক কণিকা হৃদয়ের, এক ঝুড়ি ভালোবাসার মোহর’। তাঁকে কবিতা শোনাতে পারাটাই বড় সৌভাগ্যের। তিনি শোনার পর আশীর্বাদ করেছিলেন। বলেছিলেন - ‘তোমার লেখা খুব ভালো লাগে। রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি নিজের লেখা আধুনিক গানগুলোও গেয়ো।’ ওঁর ওই প্রশংসা কখনও ভুলব না। এটা একটা লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট ।
প্র: গীতবিতানের সব গান গাওয়ার ভাবনা এল কীভাবে?
স্বাগতালক্ষ্মী: গীতবিতানের সব গান গাওয়া তো একরকম পাগলামি। ওটা দেখে লোকে রসিকতা করেছিল। তবে হঠাৎ করে ভাবনাটা আসেনি। ২০০৫ সালে আমার চোখে একটা ভয়ঙ্কর অসুখ হয়। তখন ভয় হয়েছিল, আর চোখে দেখতে পাব কি না। সেটা সারতে প্রায় ১ বছর লেগেছিল। ওই বছরের নভেম্বরে আমার দুই চোখের দৃষ্টি প্রায় চলেই গিয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে যখন চোখ দুটো সুস্থ হচ্ছে, তখন মনে হল, এটাই সেরা সময় ‘একলা গীতবিতান’ করে ফেলবার। চোখে না দেখতে পেলে আমি তো খেতে পাব না! কারণ গান গাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ২১০০ গানের হয়তো ৪০০ জানি। বাকি ১৭০০ গানের স্বরলিপি দেখে গাইতে হবে। তবেই শেখাতে পারব। তখন ভাবনা আসে, সবকটা গানই রেকর্ড করে রাখি। এতে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে এলে আমি গানটা শুনে শুনে গাইতে পারব। এক অর্থে লক্ষ্মীর কথা ভেবেই সরস্বতীর কাছে আসা!
প্র: ‘একলা গীতবিতান’ গাওয়ার পর ছাত্রছাত্রীদের থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন?
স্বাগতালক্ষ্মী: গানের ছাত্রছাত্রীরা এখনও এর জন্য আমাকে তাদের ভালোলাগার কথা জানায়। কোনও অনুষ্ঠানে বা মাঝরাস্তায় হঠাৎ দেখতে পেলে ছুটে এসে ঘিরে ধরে। এই নিয়ে কথা বলে। নিজে মুখে হয়তো বলা উচিত নয়, তবে এটা সত্যি যে একলা গীতবিতান একভাবে ইতিহাস হয়ে থাকবে।
প্র: গোটাটাই কি নিজের প্রোডাকশন ছিল?
স্বাগতালক্ষ্মী: গোটাটাই নিজের প্রোডাকশন। উল্টোডাঙার কাছে ধুন অ্যাকোয়াটিক্স স্টুডিয়ো ভাড়া নিয়েছিলাম। তাঁদের বলেছিলাম, অনন্তকালের জন্য লাগবে। শুনে আশ্চর্য হয়েছিলেন। পরে বলি, ‘জানি না আমি আদৌ কাজটি শেষ করতে পারব কি না!’ প্রথম প্রথম ১০-২০টা করে গান রেকর্ড করতাম। পরে দিনে ৫০টা করে গান রেকর্ড করেছি। নেশাই বলো আর ঘোরই বলো, অজানা গানের স্বরলিপি দেখেও তখন মনে হচ্ছে এ গানটা আমার জানা। অদ্ভুত অলৌকিক ব্যাপার হয়েছিল। এইভাবে সাড়ে তিন মাস মানে ৮৫ দিনে গোটা প্রোজেক্ট শেষ করি। শেষ স্বরবিতান থেকে গাওয়া শুরু করেছিলাম। শেষ রেকর্ডিংটা ছিল ‘কোন খেলা যে খেলব কখন’।
প্র: আগে রেকর্ড করা কোনও গান নতুন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে আবার রেকর্ড করতে ইচ্ছে করে?
স্বাগতালক্ষ্মী: তা তো করেই। কোভিডের সময় যেমন রোজ একটা করে হাজার দিনে হাজারটা গান রেকর্ড করেছিলাম। করোনায় পৃথিবীর অনেকেই তাদের পরিজনদের হারিয়েছেন। আমার দাদা আর কাছের এক দিদিকে হারিয়েছি আমি। আমার স্টুডেন্টরাও তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলত। এই ঘটনাগুলো মনে ছাপ ফেলেছিল। ওই কাজটার নাম ছিল - ‘দুঃসময়ের গান’। সারারাত ধরে কাজ হত। করোনা বলে বাড়িতেই সব করেছি। রেকর্ডিস্ট, বাজিয়ে, গাইয়ে সবই আমি। এমনকি মিউজিক ভিডিয়োও আমি বানাতাম। প্রতিদিন সকালে গান আপলোড হত। ১ হাজার দিনের মধ্যে এক দিনও বাদ যায়নি। আবার, একলা গীতবিতানের আগে দুর্বাদল চট্টোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনাতেও রেকর্ডিং করেছি।
প্র: এখনকার প্রজন্মের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান কারা ভালো গাইছে?
স্বাগতালক্ষ্মী: জয়তী (চক্রবর্তী) ভীষণ ভালো গাইছে। ইমনও (চক্রবর্তী) খুব ভালো গায়। এরিনা মুখোপাধ্যায় রয়েছে সেই তালিকায়। এছাড়া, শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের মধ্যে রয়েছে ঋতপা মুখোপাধ্যায়, প্রিয়ম মুখোপাধ্য়ায়। এখন সব নাম মনে করে বলা মুশকিল (একগাল হাসি)!