মঙ্গলবার ১৯ এপ্রিল। বাঙালি জীবনে কিছু তারিখ খুব আলাদা। যেমন পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ। সে রকমই হয়তো ১৯ এপ্রিল। তবে এটি বাস্তব-অবাস্তব মিলিয়ে একটা মিথের মতো। নব্বইয়ের দশকে যখন বাজারি সিনেমার দৌলতে বাঙালি দুঃখে-অভিমানে চোখ কচলাচ্ছে, তখন ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’ এনেছিল টাটকা বাতাস, পর্দায় উঠে এসেছিল সম্পর্কের দ্যোতনা আর কিছু না পাওয়ার কথা।
গড়পড়তা বাঙালিকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে ‘উনিশে এপ্রিল’ কি আর্ট ফিল্ম ছিল, অনেকেই একমত হবেন না। সিনেমা দেখানোর শিল্পে অদ্ভুত বুনোট বেঁধেছিলেন পরিচালক সরোজিনী, অদিতি, সুদীপ, মণীশ আর সোমনাথের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে।আজকের দিনেও যদি নতুন করে চা বিস্কুট সহকারে ‘উনিশে এপ্রিল’ দেখতে বসা হয়, অবধারিত চোখে পড়বে মা-মেয়ের বদলে যাওয়া সম্পর্কের রসায়ন, শ্যাওলা হয়ে যাওয়া পিতৃতন্ত্র আর নিঃশব্দ চাহনির বদলে যাওয়া কথার ভাষা। বলতে দ্বিধা নেই এই সিনেমার সেরা পাওনা ছিল অপর্ণা সেন ও দেবশ্রী রায়ের জুটি। বাংলা সিনেমায় মা মেয়ের মেলবন্ধনের খুব একটা বেশি উদাহরণ নেই। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সুদীপের চরিত্র নিয়ে আলোচনা অনেক কম হয়েছে। তবে অভিনেতা প্রসেনজিৎ এরকম হাতে গোনা রক্তমাংসের চরিত্রে প্রাণ দিয়েছেন, যেখানে বড় চোখ করে প্রতিশোধের কথা বলা নেই কিংবা কারণে-অকারণে মারধর করার অভিপ্রায় নেই।
মণীশ চরিত্রটি অদ্ভুত রূপকের ভূমিকা পালন করেছে সিনেমা জুড়ে। জ্যান্ত মণীশ সিনেমায় নেই বললেই চলে, কিন্তু সরোজিনী ও অদিতির মধ্যে যোগসূত্র ও দেওয়াল কিন্তু মনীশ নিজেই। শিল্পী সরোজিনীর জমকালো রুটিন জীবন, খ্যাতির বিড়ম্বনা, সংসারের সুতোর টানের সঙ্গে বোর্ডিং স্কুলে বড় হওয়া অদিতির বাবার আদর্শের প্রতি টান কিংবা মায়ের খ্যাতির ছায়ায় বড় হতে না চাওয়ার তীব্র প্রত্যাশা বাস্তবের অদিতিকে গড়পড়তা বাঙালির অনেক কাছের করে দিয়েছে। সোমনাথ-সরোজিনীর সম্পর্ক কি আজকের লিভ ইনের মতো ছিল?
সরোজিনীর চরিত্রকে নতুন করে ভাবার সুযোগ দিয়েছে এই স্মার্টফোনের যুগ। নব্বইয়ের দশকের রক্ষণশীল বাঙালি পরিবারের কাছে সরোজিনী একটু বোহেমিয়ান, পরিবার করতে না চাওয়ার সমালোচনায় দগ্ধ হলেও, এই শতকের মানুষের কাছে কিন্তু সরোজিনীর জীবনের, তার ইচ্ছার, উপলব্ধির স্বীকৃতি রয়েছে। আর সকলের মনে আছে যখন সিনেমার শেষে অদিতি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল নিজের ঘরের। সুদীপ কি আর সুযোগ পেয়েছিল? দর্শকের জন্য ছিল কিছু ভাবার কথা। এখানেই বোধহয় ‘উনিশে এপ্রিল’-এর সার্থকতা।
বছরের পর বছর যায়। ঝিরিঝিরি দূরদর্শন থেকে সাহসী রঙিন হইচইয়ের মধ্যে বাঙালি দৌড়ছে বটে! সিনেমার ভাষায় বললে বাঙালি জীবনে ‘বাইসাইকেল থিভস’ বা ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ বা ‘শাটার আইল্যান্ড’ নেই, কিন্তু একখানি ‘উনিশে এপ্রিল’ আছে। তাই প্রতি বছর অন্তত এই দিন, বদলে যাওয়া সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে বাঙালি ভাবা প্র্যাকটিস করবে।