উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি হাওয়া, পাহাড়ের মাটির গন্ধ, পাহাড়ি রাস্তার বাঁক - কার না সেই মায়াবী দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে? সম্ভবত এমন কোনও বাঙালি নেই, যিনি সেই টান অনুভব করেন না। কিন্তু সময়ের অভাব হয়ত অনেককেই আজও ছবি, ভিডিয়োর আড়ালে সেই মায়াবী পাহাড়ের রূপ দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এখনও পাড়ি দেননি সেই পথে। তবে স্বপ্নের পাহাড়ের সঙ্গে দেখা করতে যে লম্বা একটা ছুটি লাগবে, সেটা মোটেও নয়। বরং দার্জিলিং ও ঘুমে চুটিয়ে মজা করে লামাহাটার পাইন বন, মিরিকের লেক, গোপালধারা ও পেশকের চা-বাগানেও ঘুরতে মেরেকেটে চার রাতের বেশি লাগবে না।
অর্থাৎ ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বুধবার উত্তরবঙ্গগামী ট্রেন ধরে ফেললেই কেল্লাফতে। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবারের সঙ্গে রবিবার জুড়ে নিয়ে অনায়াসে চঞ্চল মনটাকে এক স্নিগ্ধ, শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশে, সবুজের আবেশে মিশিয়ে দিতে পারবেন। মনে হবে যে এই মেঘের আনাগোনা চলতে থাকুক। শুধু থেমে যাক সময়। কীভাবে ট্যুর প্ল্যানিং করবেন, রইল সেই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। তবে আগে দেখে নিন যে চার বা পাঁচদিনের ট্যুরে কোথায় কোথায় ঘুরবেন?
কুয়াশামাখা ঘুম স্টেশনকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে এগোলে খুব সহজে মনে একটা ট্যুর প্ল্যানিং গেঁথে নিতে পারবেন। ঘুমের উত্তরে আছে দার্জিলিং। দক্ষিণে আছে সোনাদা এবং কার্শিয়াং। আরও দক্ষিণে শিলিগুড়ি আছে। পশ্চিমে আছে লেপচাজগৎ, শুখিয়া এবং সীমানা। দক্ষিণ-পশ্চিমে মিরিক এবং তাবাকোষি। আর পূর্বে আছে পাইনে মোড়া লামাহাটা, তাগদা, তিঞ্চুলে, রঙ্গারুণ এবং, দাওয়াইপানি।
গোপালধারা চা বাগান, মিরিক, মিরিক লেক, সীমানা ভিউ পয়েন্ট, ঘুম স্টেশন, ঘুম মনাস্ট্রি, দার্জিলিং, আশপাশের পয়েন্ট, লামাহাটা, রঙ্গারুণ বা দাওয়াইপানি বা তাগদা, তিঞ্চুলে, পেশকের চা বাগান, তিস্তা বাজার, সেবক। এবার দেখে নিন যে কীভাবে আপনার পুরো ট্যুর সাজাবেন।
প্রথম থেকে তৃতীয় দিন
মিরিকের সাজানো পথ ধরে শিলিগুড়ি থেকে সোজা সীমানায় চলে যান। নেপাল সীমান্তে একটা রাত কাটিয়ে নিয়ে পরদিন সকাল-সকাল দার্জিলিঙে চলে আসুন। মোহময়ী লেপচাজগৎ, ঘুম স্টেশন পেরিয়ে চলে আসবেন 'পাহাড়ের রানি'-র কাছে। মনাস্ট্রি, পিস প্যাগোডা থেকে ম্যালে চলে আসুন। কিছুটা হয়ত ভিড় হবে। কিন্তু দার্জিলিঙে এসে ম্যালে সময় একপাক ঘুরে না গেলে মনটা কেমন-কেমন করবে। তাই ম্যালে হেঁটে ঘুরে-টুরে ডিনার সেরে নিন।
যদি ‘পাহাড়ের রানি’-র জন্য একটা বাড়তি দিন রাখতে চান, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সীমানা থেকে দার্জিলিঙে পৌঁছে টুকিটাকি কেনাকাটি সেরে রাখতে পারেন। তারপর ম্যালের পিছনে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। সন্ধ্যে নামার আগে পর্যন্ত সেখানেই থাকতে পারেন। মনটা একেবারে ভালো হয়ে যাবে। তারপর ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে একটা লম্বা ঘুম দিতে পারবেন। তবে টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় সূর্যকে উঠে দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখার প্ল্যান থাকলে অ্যালার্মটা জলদি দিয়ে রাখতে হবে।
যদি সেই প্ল্যান না থাকে তাহলে সকালের ঘুমটা ভাঙবে পাখির কিচির-মিচিরে। সেই মুহূর্তটা এতটাই মায়াবী লাগে যে মনে হবে আপনার ঘুমটা ভাঙানোর জন্যই পাখিরা যেন ডাকতে শুরু করেছে। আর সেই মায়াবী পরিবেশে ঘুমটা ভাঙার পর রেডি হয়ে পুরো দিনটা দার্জিলিঙে কাটান। পিস প্যাগোডা, রক গার্ডেন, ঘুম মনাস্ট্রি, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের মতো লোকাল সাইটি-সিয়িং সেরে ফেলুন। বিকেলে সোনালি আভা পাহাড়ের পশ্চিম দিগন্তে মিশে যাওয়ার আগেই আবারও ফিরে আসুন ম্যালের রাস্তায়। পড়ন্ত বিকেলে পাখিদের ডাক, লাইভ গান-বাজনা, গল্প গুজবের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে যাবে তৃতীয় দিন (যদি দার্জিলিঙে একদিন থাকেন, তাহলে দ্বিতীয় দিন)।
চতুর্থ ও পঞ্চম দিন
এবার ঘুমের পূর্বদিকে রওনা দিন। পথে বিখ্যাত পার্ক লামাহাটায় নামতে ভুলবেন না। তাছাড়া রঙ্গারুণ, দাওয়াইপানি, তাগদা অথবা তিঞ্চুলে যেতে পারেন। প্রথম দুটি জায়গা এখনও বেশ অফবিটই আছে। তবে তাতে ঘাবড় যাবেন না। কারণ পাহাড়ে যত ভিতরে যাবেন, তত পাহাড়ি সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন। পাহাড় যেন নিজের আরও কাছে টেনে নেবে। পাহাড় যেন আরও নিজের রূপ উন্মুক্ত করে দেবে। সেরকম মোহময়ী পরিবেশে হোম স্টে'তে থেকে প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ডে পাহাড়ের নির্জনতাকে উপভোগ করতে পারবেন। তাই এই চারটি জায়গার মধ্যে এবার একটি জায়গা ‘মাস্ট’। নিজের পছন্দ মতো ডেস্টিনেশনে সেটা রঙ্গারুণ বা দাওয়াইপানি বা তাগদা বা তিঞ্চুল হোক) পৌঁছে সারাদিন গ্রামে হেঁটে বেড়ান। আর সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের সঙ্গে গরম-গরম স্ন্যাক্স-সহ আড্ডা জমে যাবে।
কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসবে, তা বুঝতেও পারবেন না। কিন্তু দূর পাহাড়ের আলো এবং আকাশের তারা-গ্রহ মিলেমিশে একাকার হয়ে রাত বাড়বে, তত ফেরার দিন এগিয়ে আসবে। তাতে মনটা হু-হু করলেও পরদিন তিস্তাবাজার হয়ে সেবকের সবুজ জঙ্গল পেরিয়ে যখন ফেরার পথ ধরবেন, তখন হৃদয়ের এককোণায় পাহাড়ের নামটা চিরকালের মতো খোদাই হয়ে যাবে। যে প্রেমে হাবুডুবু খেতে-খেতে ট্রেনের অপেক্ষা করতে থাকবেন। সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে যাবেন যে আমারও ফিরে আসবেন পাহাড়ের কোলে।
(লেখক পরিচিতি: 'পাহাড় পাহাড় শুধু পাহাড়'- এটাই জীবনের মূলমন্ত্র সানিয়া ধরের। তাঁর মতাদর্শ খুব সহজ, ‘এমনভাবে বাঁচতে হবে, যাতে নিজেই নিজের জীবনের প্রেমে পড়ে যাওয়া যায়।’ আর ঠিক সেটাই করেন তিনি।)