শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা-ব্র্যান্ড মোদীই ভরসা, এটা হতেই পারে বিজেপির ট্যাগলাইন। যেভাবে তিনি প্রায় একার জোরে দলকে পাঁচের মধ্যে চারটি রাজ্যে জেতালেন, তাতে ঘোর সমালোচকরাও এটাই বলতে বাধ্য হবেন। বিশেষত উত্তরাখণ্ড ও গোয়ায় জয়ের নেপথ্যে শুধু তিনিই। কার্যত ৯০-এর ভারতীয় দলের সচিনের মতো, অন্যদের দুর্বলতা ঢেকে দলকে টেনে নিয়ে গেলেন তিনি।
কিন্তু এই জয় কোনও ভাবেই সহজ ছিল না। ২০১৯ লোকসভা জয়ের পরেই একের পর এক ইস্যুতে ব্যাকফুটে গিয়েছে বিজেপি। মোদী-শাহ জুটি সম্ভবত ভেবেছিল, বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ। এই সুযোগে সিএএ-এনআরসি-র মতো বিষয়গুলি সহজেই পাশ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। শাহিনবাগের আক্রোশে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ পায় বিরোধীরা। সিএএ-এনআরসি দুটোই আজ ঠান্ডা ঘরে। ঠিক তারপরেই কোভিডের ধাক্কা। বিশ্বের সবচেয়ে কড়া লকডাউনে সবচেয়ে খারাপ হাল হয় দরিদ্রদের। ঘরে-বাইরে সমালোচনায় বিদ্ধ হয় মোদী সরকার। উত্তরপ্রদেশে গণচিতার সেই ছবি ভাইরাল হয়ে সারা বিশ্বজুড়ে। ওঠে নিন্দার কলরব। অক্সিজেনের অভাবে সারা দেশ জুড়ে তখন হাহাকার। পুরো দমে এই ইস্যুতে মোদীর ওপর অগ্নিবর্ষণ করে বিরোধীরা। তখনই ফ্রি রেশন ও পরবর্তীকালে ফ্রি ভ্যাকসিন-সহ একাধিক জনমুখী ঘোষণার মাধ্যমে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে শাসক দল।
এর ঠিক পরে কৃষি আইন নিয়ে ফের বিরোধীদের লোপ্পা বল দেয় বিজেপি। যেভাবে এগুলি পাশ হয়েছিল, তাতেই চাষীদের মনে অবিশ্বাস জন্মে যায়। শুধু পঞ্জাব নয়, ক্রমশ বিজেপির গড় পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেও এই নিয়ে অসন্তোষের আগুন ছড়িয়ে যায়। এরপর যখন লখিমপুর খেরিতে মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে চাষীদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেওয়ার, মনে হয়েছিল বিজেপিই হয়তো সেই ভারে পিষ্ট হয়ে যাবে। এই তিনটি ইস্যুতেই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইমেজ কালিমালিপ্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সঠিক সময় নিজের ইগো বিসর্জন দিয়ে দলের জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নিজের কথায়, দেশের কথা ভেবে তিনি কৃষি আইন বাতিল করেন। সেটার মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশে অন্তত তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে যে জাটভোট ও সমগ্র কৃষক শ্রেণি সংঘবদ্ধ হচ্ছিল, সেটাকে ভেঙে দিতে সক্ষম হন। সাময়িক ভাবে মুখ পুড়লেও দলের দীর্ঘমেয়াদি হিতের কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেন মোদী।
তবে এই তো গেল কেন্দ্রীয় স্তরে নানান সমস্যার চরৈবতি। এছাড়া রাজ্যস্তরেও বিভিন্ন সমস্যা বিজেপিকে কুরে কুরে খেয়েছে। উত্তরাখণ্ডে পাঁচ বছরে তিনটি মুখ্যমন্ত্রী। ধামি তো ভোটে হেরেই গেলেন। অন্যদিকে পারিক্কর পরবর্তী বিজেপি গোয়ায় এখনও শক্ত জমিতে দাঁড়ায়নি। মুখ্যমন্ত্রী সাওয়ান্তকে কল্কে দিতেন না তাঁর দলের নেতারাও। এই দুই রাজ্যেও শেষ পর্যন্ত বিজেপিকে বৈতরণী পার করালেন সেই মোদী। স্থানীয় স্তরে এতটাই অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি ছিল যে কার্যত তাঁর নামেই ভোট করতে হয়ে বিজেপিকে। সংগঠনকে হাতিয়ার করে ব্র্যান্ড মোদীই ফের হয়ে ওঠেন জয়ের ফরমুলা।
এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে, এমন কী করছেন মোদী, যে প্রায় দশ বছর ধরে এভারগ্রিন তাঁর নির্বাচনী আবেদন? বিশেষত একের পর এক ইস্যুতে যেখানে ধাক্কা খেয়েছে তাঁর সরকার। কোভিডে ত্রাহি ত্রাহি রব, রেকর্ড বেকারত্ব, দলের নেতাদের বিরুদ্ধে জনরোশ— এই ত্র্যহস্পর্শকে অতিক্রম করে বিজেপি জিতেছে। নিশ্চিত ভাবেই আজকে বিজেপি তো শুধু একটি দল নয়, তারা মহীরুহ। ভারতীয় রাজনীতিতে এখন বিজেপি বনাম অন্যরা। যেই স্থানটি কংগ্রেস প্রায় ৬ দশক ধরে রেখেছিল, মাত্র এক দশকেই সেই আসনে অধিষ্ঠিত বিজেপি। আজ ভোটারদের কাছে তারাই ডিফল্ট চয়েস। এবং এর সবের মূলে যিনি আছেন, তিনি নিশ্চিত ভাবেই প্রধানমন্ত্রী মোদী। যেটা তাঁর পক্ষে কাজ করে, সেটা হল অমলিন ভাবমূর্তি। ডিমোনিটাইজেশনের লম্বা লাইন থেকে কোভিডের সময় অক্সিজেনের সমস্যা— মানুষ হয়তো রেগে গিয়েছেন, কিন্তু কখনও আস্থা হারাননি মোদীর ওপর। তাঁর কর্মপন্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ওঠেনি। সেই কারণেই হয়তো ভোটাররা ত্রুটি বিচ্যূতিগুলিকে খাটো করে দেখেছেন। তাদের মনে হয়েছে, চেষ্টা তো করছে, হয়তো পুরোটা এখনও আসেনি। লকডাউনের সময় যে আশি কোটি বাড়িতে বিনামূল্যে রেশন গিয়েছে, উজ্জ্বলা থেকে জনধন প্রকল্পের লাভ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা গেলাসের জল আধা ভর্তি বলেই মনে করেছেন।
চাকরি হয়তো আসেনি, কিন্তু অন্তত ঘর চালাবার আনাজের জোগান হয়েছে। সেই কারণেই মানুষ দুই হাত তুলে ফের আশীর্বাদ করেছেন বিজেপি প্রার্থীদের। এই সবের সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে ধর্মের আফিম। এবারের ভোটে হয়তো সেটা খুব একটা উঁচু ডেসিবেলে ছিল না, কিন্তু উত্তরপ্রদেশে অন্তত দুই পক্ষই চেষ্টা করেছে নিজেদের মতো করে। ৮০-২০-র সমীকরণ বা বুলডোজার বাবা নিয়ে মাতামাতির নেপথ্যে অন্তর্নিহিত ইশারা বুঝতে সমঝদার হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এই সবের ককটেলই রুচেছে ভোটারদের। শত পাঁকে পরেও তাই পদ্ম প্রস্ফূটিত। ২০২৪-র স্টেশন প্রায় এসেই গেল। হ্যাঁচকা চেন টেনে বিরোধীরা মোদী এক্সপ্রেসকে থামাতে পারবেন, ক্রমশই বিলীন হচ্ছে সেই সম্ভাবনা।