পশ্চিমবঙ্গের সর্বাপেক্ষা উত্তরে অবস্থিত দার্জিলিং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা কেন্দ্র। দীর্ঘদিন ধরে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের মত জাতিসত্তার আন্দোলন, চা বাগানে সমস্যাসহ একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে দার্জিলিং। এই কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রগুলির পাঁচটি দার্জিলিং জেলায় অবস্থিত, এছাড়া একটি করে বিধানসভা কেন্দ্র কালিম্পং জেলা এবং উত্তর দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত। বিধানসভা কেন্দ্রগুলি হল যথাক্রমে কালিম্পং, দার্জিলিং, কার্শিয়াং, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি, শিলিগুড়ি, ফাঁসিদেওয়া ও চোপড়া। এর মধ্যে মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি এবং ফাঁসদেওয়া কেন্দ্রদুটি যথাক্রমে তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত। দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রটি ১৯৫৭ সাল থেকে লোকসভা কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে ২০০৯ সাল থেকে পুনর্গঠিত লোকসভা এবং বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এবার মূল লড়াই বিজেপির রাজু বিস্তার সঙ্গে তৃণমূলের গোপাল লামার। অন্যদিকে আছেন কংগ্রেসের মুনিশ তামাং। বিজেপির চিন্তা বাড়িয়ে গোঁজ প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রধান বিমল গুরুং বিজেপিকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছেন। শেষ বিচারে সেটাই তফাত গড়ে দেয় কিনা, সেটা দেখার।
১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে জাতীয় কংগ্রেস রাজনৈতিকভাবে আধিপত্য বিস্তার করলেও মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বেশ কতগুলি লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। জাতীয় দলগুলি ছাড়াও গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এবং অন্যান্য বেশ কিছু আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি দার্জিলিঙের রাজনৈতিক পরিসরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে বরাবর। বর্তমান সময়ে এই কেন্দ্রটিতে ভারতীয় জনতা পার্টি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন বর্তমানে কিছুটা নিস্তেজ হলেও এই অঞ্চলের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। ২০১৯ সালের তথ্য বলছে গত লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং কেন্দ্রের প্রায় ১৪ লক্ষ ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। এই নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে রাজু বিস্তা জয়লাভ করেন।
দার্জিলিং কেন্দ্রের লোকসভা নির্বাচনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যাবে দ্বিতীয় লোকসভা নির্বাচনে ১৯৫৭ সালে প্রথম দার্জিলিং কেন্দ্র থেকে জয় লাভ করেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের থিওডোর মেনিন৷ এর পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে ১৯৬২ সালের নির্বাচনে থিওডোর মেনিন এই কেন্দ্র থেকে ফের জয় লাভ করেন। তবে ১৯৬৭ সালে নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী মৈত্রী বসু দার্জিলিং আসনটি থেকে জয়লাভ করেন। ১৯৭১ সালে প্রথমবারের জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর দখলে আসে কেন্দ্রটি। সিপিআই(এম) প্রার্থী রতনলাল ব্রাহ্মণ এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন। এরপরের লোকসভা নির্বাচনে ১৯৭৭ সালে ফের ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কৃষ্ণবাহাদুর ছেত্রী এই আসনটিতে সাংসদ নির্বাচিত হন। তবে ১৯৮০ সালের নির্বাচনে ফের এই আসনটি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর পক্ষ থেকে আনন্দ পাঠক জয়লাভ করেন। এর পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। মধ্যবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার গোর্খাল্যাণ্ডের দাবিতে আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ভাগের এই অঞ্চলটি। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের প্রভাবে শাসক দল বারংবার বেকায়দায়ও পড়েছে এই কেন্দ্রে। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট-এর পক্ষ থেকে ইন্দ্রজিৎ খুল্লর এই কেন্দ্রে জয়লাভ করেন৷ এর পরবর্তী নির্বাচনে চমকপ্রদভাবে ইন্দ্রজিত জয় লাভ করলেও তিনি দল পরিবর্তন করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের টিকিটে জেতেন।
১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনগুলিতে জিএনএলএফ নির্বাচন বয়কটের ডাক দেন। এই সময়কালে পরপর তিনবার কেন্দ্রটিতে জয়লাভ করে সিপিআই(এম)। তবে ২০০৪ সালে নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি ফের জাতীয় কংগ্রেস দখল করে সিপিআই(এম)কে হারিয়ে৷ তৃণমূল কংগ্রেস বিগত বছরগুলিতে বাংলায় সরকার চালালেও দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রটিতে এখনও পর্যন্ত একবারের জন্যও জয়লাভ করতে পারেনি তারা। ২০০৪ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দাওয়া নরবুলা জয় লাভ করেন। তবে এর পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন গুলিতে বাকি রাজনৈতিক দলগুলি থেকে অনেকটাই এগিয়ে থেকে জয়লাভ করে ভারতীয় জনতা পার্টি। ২০০৯ এর ২০১৪ এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং কেন্দ্র থেকে যথাক্রমে জয়লাভ করেন যশোবন্ত সিং, এসএস আলুওয়ালিয়া এবং রাজু বিস্ত। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র বিরুদ্ধে তৃণমূল দাঁড় করিয়েছিল তাদের তারকার প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়াকে তারপরেও মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় পাহাড়ি বিছেকে।
দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক দলের আধিপত্য দেখা যায় না। তবে বিগত ১৫ বছর পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বলছে, ভারতীয় জনতা পার্টির ভিত্তি বেশ শক্তপোক্ত হয়েছে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দার্জিলিং কেন্দ্রটির বিভিন্ন বিধানসভা ক্ষেত্রগুলিতে কোন রাজনৈতিক দলের ফল কেমন হয়েছিল, জানা যাক সেই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য। গোটা রাজ্যে ভোটের শতাংশের নিরিখে প্রথম স্থানে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ৪৮.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তারা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি ৩৮.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) যথাক্রমে ৪.৮ শতাংশ এবং ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে রাজ্য রাজনীতিতে বেশ অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল।
২০২১ সালের লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কালিম্পং বিধানসভা ক্ষেত্রে জয়লাভ করেছিল নির্দল প্রার্থী রুবেন সাদা লেপচা। অন্যদিকে দার্জিলিং বিধানসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির নীরাজ তামাং জয় লাভ করেন, যার জয়ের মার্জিন ছিল ১২ শতাংশেরও বেশি। কার্শিয়াং বিধানসভা ক্ষেত্রটিতে ভারতীয় জনতা পার্টির বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা জয়লাভ করেন, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি এবং শিলিগুড়ি এই দুটি আসনেও ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে যথাক্রমে আনন্দময় বর্মন এবং শঙ্খ ঘোষ জয়লাভ করেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে এই আসনগুলিতে কোথাও ৩০ শতাংশ, কোথাও ২০ শতাংশের ব্যবধানে জয় হাসিল করে ভারতীয় জনতা পার্টি। দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভাগুলির মধ্যে একমাত্র চোপরা বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে হামিদুল রহমান জয়লাভ করেন। এক্ষেত্রে জয়ের মার্জিন ছিল ৩২ শতাংশ। সার্বিক বিচারে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায় ২০২১ এর বিধানসভার ক্ষেত্রেও। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে উত্তাল হয়নি দার্জিলিং। ২০২৪ সালের নির্বাচনী ফলাফল কোন দিকে যায় সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে আমাদের।