জ্যোতিকা জ্যোতি, অভিনেত্রী, বাংলাদেশ
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।' ছোটবেলায় যখন ২১ ফেব্রুয়ারির ভোরে এই গানটা শুনতাম, তখন মনটা ছটফট করে উঠত। আমি গ্রামে (ময়মনসিংহের গৌরীপুরে) বড় হয়েছি, তাই সেখানে তো খুব বেশি ক্লাব, সংগঠন এসব তখন কিছুই ছিল না।এই দিনটা স্মরণ করতে স্কুলে যেতাম। পাড়ারই কোনও বাড়ির গাছ থেকে ফুল নিয়ে স্কুলের শহিদ বেদীতে ফুল দিয়েছি। গ্রামে বা গ্রামের স্কুলগুলিতে তখন তো আলাদা করে শহিদ বেদী ছিল না, তাই নিজেরাই শহিদ বেদী তৈরি করে সেখানে ফুল-মালা দিতাম।
এরপরে যখন গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসি, তখনও অনুভব করলাম ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটা নিয়ে আবেগ বিন্দুমাত্র কমেনি। সেসময়ও যখন এইদিনে একইভাবে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… গানটা শুনতাম তখনও বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠত, অদ্ভুত অনুভূতি হত। ঢাকায় আসার পর শুরুর দিকে আমার সেভাবে বন্ধু-বান্ধব ছিল না। তবু একাই ছুটে যেতাম শহিদ মিনারে, শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যেতাম। একইভাবে, সেই ছোটবেলার মতোই ফুল দিতাম।শুধু বড়রা নন, এইদিন শহিদ মিনারের সামনে বহু ছোটরাও ভিড় করে, তাঁরা তাঁদের মুখে হয়ত দেশের পতাকা কিংবা কোনও অক্ষর এঁকে নেন। দেখতে দারুণ লাগে আমার।আমিও বেশ কয়েকবার এঁকেছি। ওইদিন শহিদ মিনারের সামনে অনেকেই থাকেন এগুলি এঁকে দেওয়ার জন্য, ওটা ওঁদের ওই একদিনের ছোট্ট ব্যবসা বলতে পারেন।
আরও একটু পরের দিকে গিয়ে ঢাকায় তখন আমার বেশকিছু বন্ধুবান্ধব হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে তখন বন্ধুদের সঙ্গে শহিদ মিনারে যেতাম, ফুল দিতাম, সকলের সঙ্গে আল্পনা আঁকতাম। এবং ২০ফেব্রুয়ারী রাত থেকেই তা শুরু হতো।আসলে বন্ধু-বান্ধব থাকাটা বিষয় নয়, বিষয়টা আবেগ। ছোট থেকে সেটা একই থেকে গিয়েছে। 'একুশে ফেব্রুয়ারি…' ওই গানটা শুনলে আজও একই অনুভূতি হয়।
আর এখন আমি বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির ‘গবেষণা প্রকশনা বিভাগ’-এ পরিচালক হিসাবে দায়িত্বে রয়েছি। তাই এবার শিল্পকলা অ্যাকাডেমির তরফেই ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেব। শহিদ মিনারে ফুল দিতে যাব। এবার তো আমার বড় দায়িত্ব রয়েছে। এবার শিল্পকলা একাডেমির স্লোগান হল ‘বিশ্বের সব মাতৃভাষাকে রক্ষা করবে বাংলাদেশ’।
আমি বলব বিশ্বের সব ভাষাকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। তবে সব থেকে আগে রক্ষা করতে হবে নিজের মাতৃভাষাকে। যেটা আমাদের মায়ের ভাষা, নিজের ভাষা। আজকাল অবশ্য দেখছি ঢাকায় একধরনের বাংলার চল হয়েছে। যে ধরনের সঙ্গে বাংলার কোনও আঞ্চলিক বা কোন বাংলারই কোনওকালের কোনও যোগই নেই। আজকাল অনেকে দেখছি, সংবাদমাধ্যমের সামনেও কথা বলতে গিয়ে সেধরনের বাংলায় কথা বলে ফেলছেন। তবে আমি এটার পক্ষপাতী নই এক্কেবারে। আমার মনে হয় বাংলাকে বাঁচাতে নিজের আঞ্চলিক ভাষা পাশাপাশি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারতে হবে।
আর যদি নতুন প্রজন্মের কথা বলি, তাঁরা তো অনেকেই ইংরাজি মাধ্যমে পড়েন। বাংলার মধ্যে তাই ইংরাজি ঢুকে পড়ে। আমি বলব, ইংরাজি আন্তর্জাতিক ভাষা, এটা শিখতে হবে, তবে নিজের ভাষার ঊর্ধ্বে কোনও ভাষার স্থান হতে পারে না। বিশ্বের অনেক এমন দেশ আছে, যাঁদের কাছে ইংরাজির প্রয়োজনও বোধ করেন না। তবে আমি অবশ্য সেটার পক্ষে নই, ইংরাজির শেখা হোক তবে নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে। যেদিন থেকে বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেদিন থেকে আমাদের এই ভাষার প্রতি দায়িত্ব আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে। এই দায়িত্ব পালন করে চলতে হবে…। সবশেষে বলব, ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!/তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!’