ছোটপর্দা থেকে উত্তরণ বড় পর্দায়। টলিউডের হিরো যশ এবার পা রাখছেন বলিউডে। সৌজন্যে ‘ইয়ারিয়াঁ ২’। ছবিতে দিব্যা খোসলা কুমারের নায়ক তিনি। শুক্রবার দিনভর তিলোত্তমায় সারলেন ছবির প্রচার। শনিবার ‘ইয়ারিয়াঁ ২’-এর কাজে মুম্বই উড়ে গিয়েছেন। শহর ছাড়ার আগে হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে একান্ত আড্ডায় ধরা দিলেন নায়ক।
মুম্বইয়ের ছেলে যশ কলকাতার ছবির হিট নায়ক। এখন আবার ব্যাক টু মুম্বই! বলা যায়, জীবনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল?
যশ: (মুচকি হাসি) আসল ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি কিন্তু কলকাতার অভিনেতা হিসাবেই ওখানে কাজ করলাম।
প্রথম হিন্দি ছবির কাজ, খুব উত্তেজিত নিঃসন্দেহে। কীভাবে এই সুযোগটা হাতে এল?
যশ: অফারটা হুট করে এসেছিল। তখন আমরা একটা আংশিক লকডাউনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচালকরা যোগাযোগ করেন, আমার সঙ্গেও তারপর কথা হয়। তবে সেইসময় ব্যাপারটা খুব সিরিয়াসলি নিইনি। এরপর পার্সোনাল কাজের জন্য মুম্বইতে গিয়েছিলাম, তো সেদিনই মিটিংটা রেখেছিলাম। দেখলাম টি-সিরিজের অফিসে আমাকে ডাকা হয়। বুঝলাম না, অফরটা তাহলে অথেনটিক। ওইদিন প্রথম আমাদের পরিচালক জুটি বিনয় সাপ্রু আর রাধিকা রাও-এর সঙ্গে আলাপ হল। আমি তো শুরুতে কিছু বুঝতেই পারছিলাম না, আচমকা আমাকে কেন ডাকা হল!
শুনলাম ছবির জন্য আপনার কোনও অডিশন নেওয়া হয়নি!
যশ: একদমই। ওইদিন ওঁনাদের জিগ্গেস করি, আমার কী অডিশন নেওয়া হবে? কারণ আমি কোনও প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি। ওঁনারা জানায় না আমরা শুধু গল্প করব। সেই গল্প ৬ ঘন্টা চলেছিল, তার পরে ওঁনারা জানালেন 'আমরা আমাদের অভয়কে (ছবিতে যশের চরিত্রের নাম অভয়) পেয়ে গেছি। ওঁনারা জানিয়েছিলেন- আমরা হাতে স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে অডিশন নেওয়ায় বিশ্বাস করি না। তোমার কাজ আমরা ইউটিউবে দেখেছি। আমরা শুধু দেখতে চাইছিলাম অভয় তোমার মধ্যে রয়েছে কিনা। সেইদিনই ভূষণজি (ভূষণ কুমার)-র চেম্বারে গেলাম। ওঁনার সঙ্গে আলাপ হল। মুখে মাস্ক লাগিয়েই গিয়েছিলাম। উনিও বললেন- সব ঠিক আছে। ব্যাস, দু-দিন পর থেকে দিব্যার সঙ্গে আমার স্ক্রিপ্ট রিডিং সেশন শুরু হয়ে গেল। আমার তো বিষয়টা হজম করতেই বেশ সময় লাগল। আরও পড়ুন-হাতে শাঁখা-পলা! পুরোদস্তুর বাঙালি সাজ, বলিউডের দিব্যাকে নিয়ে কালীঘাটে যশ, ব্যাপার কী!
যশের কোন বাংলা ছবি ‘সনম তেরি কসম’ পরিচালকদের নজর কেড়েছিল? সেই নিয়ে কোনও কথা হয়েছে?
যশ: হ্যাঁ, আমি তো প্রশ্ন করেছিলাম বিনয়-রাধিকাকে। ওঁরা জানাল আমার ‘গ্যাংস্টার’ বলে যে ছবিটা রয়েছ সেটা ওঁনারা দেখেছেন। ইয়ারিয়াঁ ২-তে যে চরিত্রটা আমি করছি, অভয় তার মধ্যে একটা প্যাথোস রয়েছে। একটা ভালনারেবল ব্যাপার রয়েছে। দুটো চরিত্রের মধ্যে অবশ্যই কোনও মিল নেই, কারণ সেখানে আমি একটা গ্যাংস্টার। আসলে সত্যি বলতে আমি নিজেও জানি না, ওঁনারা ঠিক কী দেখেছিলেন আমার মধ্যে। পুরো জিনিসটায় আমি অভিভূত, অবাক হয়েছিলাম।
ছবির টিজারে খুব আন-রোম্যান্টিক স্বামী হিসাবে অভয়কে দেখলাম, বাস্তবে যশ কেমন স্বামী?
যশ: আমার মনে হয় অভয়কে আন-রোম্যান্টিক বলাটা ভুল হবে। আসলে এই ছবির সারপ্রাইজ প্যাকেজ অভয়। যাকে ছাড়া এই ছবিটা পরিপূর্ণ হতে পারে না। ছবিটা রিলিজ হলে সবাই সেটা জানতে পারবে। এই চরিত্রটা যখন শুনেছিলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল এটা এমন একটা চরিত্র যেটার সঙ্গে বলিউড সফর শুরু করা যায়। কারণ অভয়ের কাহিনি শুনে আমার নিজের কষ্ট হয়েছিল। আমার মনে হয় দর্শককেরও সেই কষ্টটা হবে। তোমরা রোম্যান্সের কথা বলছেন, আগে পুরো ছবিটা দেখ তারপর হয়ত বলবে ‘অভয় তো রোম্যান্সটা খুব ভালো জানে’।
প্রথম হিন্দি ছবির ঝলক দেখে নুসরতের কী প্রতিক্রিয়া, আপনার সঙ্গে দিব্যার রসায়ন নিয়েই বা তাঁর কী মত?
যশ: (মুচকি হাসি) ও শুরু থেকেই সবটা জানতো। আমি ওকে গল্পটা বলেছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে ওর খুব ভালো লেগেছিল। অভয় চরিত্রটা ওর খুব ভালো লেগেছে। ‘সাঁসো কি মালা’ গানটার স্ক্রাচ যখন শুনিয়েছিলাম, তখনই বলছিল আমি দেখতে মুখিয়ে রয়েছি এই গানটা। এখন ছবিটা কেমন হচ্ছে, না হচ্ছে- দেখতে প্রস্তুত সে (নুসরত)।
তাহলে এখন কী ঘরের লোকই যশের সবচেয়ে বড় সমালোচক?
যশ: আরে না, না! নুসরত আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্টার।
টলিউডের প্রথম সারির অভিনেতা থেকে বলিউডে ডেবিউটান্ট, যশের কেরিয়ারে নতুন চ্যালেঞ্জ?
যশ: আমার কাছে দুটো আলাদা নয়। যখন কোনও অভিনেতা অভিনয় করেন তাঁকে নিজের কাজটা সম্পূর্ণ সমপর্ণের সঙ্গে করতে হয়। একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, এই মুহূর্তে বলিউডের অন্যতম লিডিং পোস্টার ডিজাইনার-ফটোগ্রাফার রাহুল নন্দা। উনি বাঙালি শিল্পীদের খুব প্রশংসা করলেন। উনি সবাইকে বললেন- ‘এই ছেলেটা খুব ভালো করছে’। আমি নিজেও জানি না আমি কী ভালো করেছি। পরে যখন কথা হল, উনি টোটাদা-র খুব প্রশংসা করলেন। রকি রানি-তে টোটাদা-র (টোটা রায় চৌধুরী) অভিনয়ে রাহুল নন্দা মুগ্ধ। বাঙালি শিল্পীরা যে মুম্বইতে পরিচিতি পাচ্ছে সেটাই গর্বের বিষয়। এটা দরকার ছিল। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকলে আমরা কোনওদিন একসঙ্গে একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে বড় হতে পারব না। বাইরে কিন্তু সবাই একে অপরকে খুব সাপোর্ট করে।
ট্রোল যশের পিছু ছাড়ে না! ইয়ারিয়াঁ ২-র টিজার মুক্তির পরেও ট্রোলড হয়েছিলেন, স্ক্রিন টাইম নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। যশ গোটা ব্যাপারটা নিয়ে কী বলবে?
যশ: আমি নেগেটিভ জিনিসকে পাত্তা দিই না। অনেকে এটাও বলছে ‘বাঙালি হিরো অনেক দিন পর হিন্দি ছবিতে লিড রোলে কাজ করছে’। আমি সেইগুলো পড়ি। সেই প্রশংসার জন্যই তো আমরা কাজ করি। ট্রোলিং-এর কথা বলতে হলে বলব, জওয়ান রিলিজের পরও শাহরুখ খানকে নিয়েও ট্রোলিং চলছে। আসলে যাদের কাজ নেই, যারা জীবনে প্রোডাক্টিভ কিছু করতে পারে না, তারাই ট্রোল করে। সেই ট্রোল আর্মির উদ্দেশে শুধু এটাই বলব God bless them, তাঁরাও জীবনে এমন কিছু করুক, যাতে তাদের বাবা-মা'রা গর্ব করার সুযোগ পায়।
বলিউডে কাজ করার পর কী শিখলে, কতটা ফারাক টলিউড আর বলিউডের? প্রযোজক যশ কোনও টিপস নিল ভূষণ কুমার-দিব্যা খোসলা কুমারদের থেকে?
যশ: ওখানে খুব যত্ন করে শ্যুট করা হয়। অনেকটা সময় দেওয়া হয় একটা শটের পিছনে। একটা শটে ২৫-৩০টা রিটেক নেওয়া হয়। কখনও আর্টিস্টের ভুলে, কখনও ক্যামেরা মুভমেন্টের দোষে। একটা চুল এক্সট্রা বেরিয়ে থাকলে রিটেক দিতে হয়। আমাদের এখানে সেটা সম্ভব নয়। তবে টলিউড এত বছর কাজ করে আমি বলতে পারি, অনেক সময় কম রিসোর্স থাকা সত্ত্বেও সকলে সেরাটা দিয়ে কাজ করে। বাজেট তো ম্যাচ করা সম্ভব নয়, সেখানে তুলনা চলে না। কিন্তু কম বাজেটে বাংলায় সকলে মন দিয়ে কাজ করে। দিন কম, বাজেট কম, হল নিয়ে মারামারি, তার মধ্যেও অল্পেতে কী করে ভালো করতে হয় সেটা বাংলা ইন্ডাস্ট্রি জানে। আসলে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সমস্যাটা হল, সবাই আমি আমি করেই ব্যস্ত। যতদিন না গোটা ইন্ডাস্ট্রি এক হচ্ছে… ক্যামেরার সামনে সবাই বলে এক হওয়া উচিত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কেউ এক হয় না।
লম্বা সময় টলিউডে গায়েব যশ। সেই নিয়ে নানান রটনা, নিন্দকদের কী বলবে?
যশ: দেখা যাবে কী করে! ২০২২-এর জানুয়ারি থেকে আমি ইয়ারিয়াঁ ২ নিয়ে ব্যস্ত। ট্রায়ালের পর ট্রায়াল চলছে, সেখানে লম্বা সময় গেছে। আমি চুক্তিবদ্ধ ছিলাম, তাই কাউকে বলতে পারিনি। প্রচুর ছবি আমাকে ছাড়তে হয়েছে। এখনও আমার কাছে ছবির অফার রয়েছে, যা সেপ্টেম্বরে শ্যুট শুরু। এবার বলো কী করে সময় দেব? নিজের প্রোডাকশনে সময় দিতে পারছি না। মেন্টালের গানের শ্যুটিং বাকি রয়েছে। আমি ঠিক করেছি ইয়ারিয়াঁ ২-র কাজ মিটলে পুজোর পর মেন্টালের শ্যুটিং শেষ করব। আমি গত দু-বছরে সত্যি আমার হাতে সময় ছিল না। আর কেন ছিল না সেটা তো ইয়ারিয়াঁ ২-র টিজার, গান থেকে লোকে বুঝতে পারছে।
বাংলায় পুজোর লড়াই নিয়ে এত্ত কথা হয়। এবারও রয়েছে। সেখানে পুজোয় যশের হিন্দি ছবির মুক্তি। প্রতিযোগিতা কীভাবে দেখছো?
যশ: না, আমি বলিউড থেকে লড়তে আসছি না। একটা হিন্দি ছবির সঙ্গে বাংলা ছবির তুলনাটা আন-ফেয়ার। হিন্দি ছবি অনেক সিনেমা হলে রিলিজ হয়। এই ক'টা সিনেমা হলেও আমাদের জায়গা পেতে মারপিট হয়। হিন্দি ছবি করছি বলে তো বাংলা ছবিকে ছোট করতে পারব না। আমি জানি এখানে কত কষ্ট করে সিনেমা তৈরি করা হয়। প্রতিযোগিতাটা বাংলা বনাম বাংলা ছবির, প্রতিবার বলি, পুজোয় এত বাংলা ছবি আসার কী দরকার? তাও আসছে।
শাহরুখ-সলমন-আমিররা,পরস্পরকে সাপোর্ট করছেন। একে অপরের ছবিতে ক্যামিও পর্যন্ত করছেন। সেই সাপোর্টের অভাব রয়েছে টলিউডে?
যশ: একদম। সবাই তো এখানে শুধু ক্যামেরার সামনেই বলে ইন্ডাস্ট্রির একজোট হওয়ার কথা বলে। বাস্তবে কেউ আসে না।
পুজোতে যশ কী কলকাতায় থাকবে?
যশ: এই রে! এই প্রশ্নের জবাবটা টি-সিরিজের প্রমোশন্যাল টিম দিতে পারবে। ২০শে অক্টোবর ইয়ারিয়াঁ ২ মুক্তি। তাই যদি প্রোমোশনের কিছু কাজ থাকে তাহলে ওখানে থাকবে হবে। বাকি ব্যক্তিগতভাবে আমি কলকাতাতেই থাকতে চাই।