রুপোলি পর্দার শাহেনশা তিনি। তাঁর দীর্ঘ অভিনয় জীবন ভরপুর একাধিক চড়াই-উতরাইতে। সাক্ষাত্ মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাত্, বোফর্স কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানো, কোম্পানির ভরাডুবির জেরে একটা সময় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন বিগ বি- তবে প্রতিবারই কোনও এক জাদুবলে ফিরে এসেছেন তিনি, ঠিক যেন ফিনিক্স পাখির মতো। ভস্ম থেকে জেগে উঠে এক পুর্নজন্ম লাভের গল্প- আজ জীবনের আরও একটা বসন্ত পার করে ফেললেন অমিতাভ। আজ তাঁর ৭৮ তম জন্মদিন।
এই ফাইটিং স্পিরিটটা আছে বলেই তো ৭৭ বছরেও করোনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন অমিতাভ। সব প্রতিবন্ধতকা জয় করতেই অভ্যস্ত তিনি, আর তাঁর এই ‘হার না মানা’র জেদটাই তাঁর অনুরাগীদের সবচেয়ে বড় অনু্প্রেরণা।
আজ অমিতাভের জন্মদিনে এক নজরে দেখে নিন বিগ বি-র জীবনের সবচেয়ে বিগ চ্যালেঞ্জ-
বোফর্স বিতর্ক ও অমিতাভ-
১৯৬৯ সালে শুরু হয়েছিল অমিতাভের অভিনয় কেরিয়ার। জঞ্জিরের পূর্বে ১২টি ফ্লপ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তারকা। তবে ব্যর্থতা ভুলে আশির দশকে বলিউডের নম্বর-১ হিরোতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। একের পর এক সুপারহিট ছবি তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল স্টারডমের শিখরে।
এরপর রাজনীতিতে নিজের ভাগ্য পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন অমিতাভ। বন্ধু রাজীব গান্ধীর ডাকে ১৯৮৪ সালে রাজনীতির ময়দানে নামেন তারকা। যে বছর আততায়ীর গুলিতে খুন হন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং উত্তর ভারত জুড়ে দাঙ্গা মাথাচাড়া দেয়। নিজের ব্যাপক জনপ্রিয়তার জেরে এলাহাবাদ থেকে নির্বাচনে সহজেই জয়ী হন বিগ বি। হারিয়ে দেন এইচএন বহুগুণার মতো হেবিওয়েট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে।
যদিও সেই উচ্ছ্বাস বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই বোফর্স কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ায় অমিতাভের। ক্ষোভে, অভিমানে লোকসভা থেকে পদত্যাগ করেন অমিতাভ। এরপর লন্ডনের আদালতে দীর্ঘ আইনি লড়াই লড়েন অমিতাভ, এবং সেই মামালয় জিতে এই কেলেঙ্কারির দায় থেকে মুক্তি পান।
'ক্লিনিক্যালি মৃত' অমিতাভ, ঘোষণা করেছিলেন চিকিৎসকরা-
বোফর্স মামলায় নাম জড়ানোর আগেই অমিতাভের জীবনের উপর দিয়ে অপর একটি সুনামি বয়ে গিয়েছে- মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন বিগ বি। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে কুলি ছবির একটি অ্যাকশন দৃশ্য শ্যুট করবার সময় মারাত্মক আহত হন অমিতাভ। পুনিত ইশ্বরের সঙ্গে ব্যাঙ্গালোর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে লড়াইয়ের দৃশ্য শ্যুট করতে গিয়ে ভুল জায়গায় পা পরে যায় অভিনেতার। এরপর টেবিলের সঙ্গে জোর ধাক্কা লাগে তাঁর- দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় অমিতাভের। একাধিক অস্ত্রোপাচার করা হয়, দেশজুড়ে চলতে থাকে প্রার্থনা। পরবর্তী সময়ে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসাপাতেল চলে চিকিত্সা। পেটের ক্ষত মারাত্মক ছিল, এরপর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তারকা। অমিতাভ নিজের ব্লগে একসময় লেখেন- কয়েক মিনিটের জন্য চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল, এরপর ভেন্টিলেটরে রাখা হয় তাঁকে। তবে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি।
হেপাটাইটিস বি'র শিকার অমিতাভ বেঁচে রয়েছেন ২৫% লিভার নিয়ে-
হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীনই হেপাটাইটিস বি ভাইরাসেও সংক্রমিত হতে হয়েছিল অমিতাভ বচ্চনকে। যা বহু বছর পর প্রকাশ্যে আসে। সেই সময় অনেক রক্তক্ষরণ হওয়ায় প্রায় ৬০ বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছিল তারকাকে, যা দান করেছিলেন ২০০ জন মানুষ। তেমনই কোনও রক্তদাতার শরীর থেকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ঢুকে পড়ে অমিতাভের শরীরে। তবে ২০০০ সাল পর্যন্ত সেই সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি বিগ বি। রুটিন হেলথ চেপ-আপের সময় জানা যায় অমিতাভের লিভারের ৭৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সারাজীবন মদ ছুঁয়ে না দেখলেও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি।
অমিতাভ বচ্চন কর্পোরেশন লিমিটেডের ভরাডুবি
রাজনীতির ময়দানে খারাপ অভিজ্ঞতা এবং নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পরেও অমিতাভের জীবন সহজ পথে এগোয়নি। আরও এক কঠিন পরিস্থিতি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। চলচ্চিত্র প্রযোজনায় পা রাখতে অমিতাভ বচ্চন কর্পোরেশন লিমিটেড বলে একটি কোম্পানি খুলেছিলেন অভিনেতা। তেরে মেরে স্বপ্নে- ছিল এই সংস্থার প্রথম প্রোডাক্ট, যা খারাপ ফল করেনি। তবে ১৯৯৬ সালে মিস ওয়ার্ল্ড বিউটি পেজেন্ট আয়োজনের দায়িত্ব নিয়ে এই কোম্পানিকে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এছাড়াও একাধিক মোটা অঙ্কের টাকার কর্মচারীও এই সংস্থার পতনের কারণ ছিল। ১৯৯৭ সালে তালাবন্ধ হয়ে যায় এই কোম্পানি, এবং অনেক টাকা দেনা হয়ে গিয়েছিল অমিতাভের। কার্যত দেউলিয়া হতে বসা অমিতাভ একটা সময় পাওনাদারদের টাকা মেটাতে জুহুর বাংলা ‘প্রতীক্ষা’ এবং আরও দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বসেছিলেন।
কোভিড- ১৯-এর সঙ্গে লড়াই
চলতি বছর জুলাইতে অতিমারী করোনার খপ্পরে পড়েন অমিতাভ। কোভিড-১৯ কাঁটা থেকে রক্ষা পাননি অমিতাভ পুত্র অভিষেক ও তাঁর স্ত্রী, অভিনেত্রী ঐশ্বর্য এবং মেয়ে আরাধ্যাও। ৭৭ বছর বয়স হওয়ায় করোনার রোগী হিসাবে হাই রিস্ক জোনে ছিলেন অমিতাভ। তাঁর পূর্ববর্তী স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়েও চিন্তায় ছিলেন চিকিত্সকরা। তবে অদম্য জেদ নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেন অমিতাভ। এবং বহু বর্ষীয়ান মানুষের মনেই সাহস জোগান কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে এই মারণভাইরাসের সঙ্গে।
কোভিড-১৯'কে হারিয়েও এতটুকুও থেমে যাননি অমিতাভ। ফিরেছেন শ্যুটিং সেটে, চালিয়ে যাচ্ছেন কেবিসির নতুন সিজনের কাজ। কারণ 'শো মাস্ট গো অন'- এই মন্ত্রেই তিনি দীক্ষিত।
অমিতাভের জীবনের লড়াইয়ের গল্প যেমন হার মানায় ছবির চিত্রনাট্যকে, তেমনই অভিনেতার ভিতরের জাদু মন্ত্র জীবনে লড়াইয়ের আর নতুন করে বাঁচার আপ্তবাক্যটাও শিখিয়ে যায় অবলীলায়।