‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!/তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!’ বাংলা ভাষা বাঙালির গর্ব, নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলার মতো শান্তি, তৃপ্তি অন্য ভাষায় পাওয়া সম্ভব নয়। তা অতুলপ্রসাদ বহু আগেই তাঁর এই গানে বলে গিয়েছিলেন। তবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশের, বাঙালিদের লড়াইটা মোটেও সহজ ছিল না। এই একুশে ফেব্রুয়ারি বহু শহিদদের রক্তে রাঙা। সেই ইতিহাসে এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে…। ১৯৫২ সালের সেই স্মৃতি আজও লালন করে চলেছেন বাঙালিরা।
এখন ২০২৩, আজ থেকে ৭১ বছর আগের সেই দিনটি এখনও কতটা গুরুত্ব রাখে? বাংলা ভাষা তাঁর কাছে ঠিক কী? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি) নিয়ে কথা বললেন বাংলাদেশ তথা বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী।
চঞ্চল চৌধুরীর কথায়, '২১ ফেব্রুয়ারি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা যদি ৭১ বছর পার করে বাঙালিদের নতুন করে বোঝাতে হয়, তাহলে সেটা আমাদের ব্যর্থতা। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি তো বাঙালির রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা উচিত। এই যে আমি কথা বলছি, যেটা বলতে চাইছি, সহজেই বুঝিয়ে ফেলছি, এটা কি সত্যিই অন্যকোনও ভাষায় বোঝানো সম্ভব? তা সে আমি যতই অন্য ভাষায় পরিপক্ক হই। নিজের মায়ের মুখের ভাষাকে ছোট করার অর্থ নিজের মা-কেই তো অপমান করা। এটা যদি এতবছর পর বাঙালিদের নতুন করে বোঝাতে হয় তাহলে সেই শহিদদের আত্মত্যাগ মিথ্যে হয়ে যায়।
নিজের জন্মদাত্রী মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলতে আজকাল অবশ্য কেউ কেউ লজ্জা পান। সেটা সত্যিই হাস্যকর। আমার প্রশ্ন, রাশিয়া, চিন, জাপান, জার্মানি সহ বেশকিছু দেশ আছে যেদেশের মানুষরা তো ইংরাজিতে কথা বলতেও চান না, খুব প্রয়োজন না পরলে। কই ওঁরা তো নিজেদের ভাষা নিয়ে লজ্জা পান না! তাহলে আমরা কেন?
এরজন্য অবশ্য কিছু পরিবার, কিছু মানুষজনই দায়ী, সেটা তাঁদের সঠিক শিক্ষার অভাব। কিছু মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যান্যরা আছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তান বাংলার থেকে ইংরাজি বললেই বেশি গর্ব করেন। ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ওই কবিতার কথা মনে পড়ছে, ‘জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না…’। সত্যিই হাসি পায়…। আসলে কে কীভাবে তাঁর সন্তানকে বড় করবেন, শেখাবেন, তা পরিবারের উপর নির্ভর করে। পরিবারের শিক্ষাতেই আমরা নিজের মা-কে, মায়ের মুখের ভাষাকে ভালোবাসতে শিখি। এ-ভালোবাসা কিন্তু লোক দেখানো নয়, অন্তরের, একান্ত আবেগের। ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে বাংলাদেশের আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কতটা আবেগ থাকবে, সেটা নির্ভর করছে তাঁদের পরিবারের উপর। পরিবার তাঁকে ২১ ফেব্রুয়ারি, বাংলা ভাষা, শহিদদের কথা কতটা বলেছে, কতটা তাঁদের মর্মে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। আমি হয়ত আজ আমার ছেলেকে ইউরোপ, আমেরিকায় পড়তে পাঠাতেই পারি, তবে যাই হোক ওকে আমি বলেছি, বাবা যে ভাষাই শেখো না কেন, বাংলাটা আগে ভালোভাবে শেখো, তারপর বাকি…। নিজের ভাষাটাই যদি ভালো না জানি, তাহলে অন্যভাষা শিখব কীভাবে? অন্যভাষা শিখতে বা বলাতে আমার আপত্তি নেই, তবে বাঙালিদের বাংলা না জানাতে অবশ্য আপত্তি আছে।
আজকাল বাংলায় কথা বলতে গেলে ইংরাজি মিশে যায়, সেটা হয়ত কালের নিয়মে বিভিন্ন ভাষা মিলেমিশে যাবে, তবে বাংলাটা হারিয়ে যেন না যায়। যে শব্দ ইংরাজিতে বলছি, সেটার বাংলা শব্দও যেন জানা থাকে।'
২১ ফেব্রুয়ারি পালন নিয়ে চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘১৯৫২ সালের সেই সময় আমি জন্ম নিই নি, কিংবা আমার বাবা-মায়েরও সেই অর্থে সেসময়ের কোনও স্মৃতি নেই। তবে তারপরেও ওঁরা আমায় সেই দিনটি কথা আমায় বলেছেন, দিনটির গুরুত্বের কথা জানিয়েছেন। আমি গ্রামে জন্মেছি এবং বড় হয়েছি। ছোটবেলায় এই দিনটিতে সকালবেলা স্কুলের সকলের সঙ্গে প্রভাত ফেরিতে বের হওয়া, এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে যাওয়া, শহিদ বেদীতে মালা দেওয়ার কথা আজও ভীষণ মনে পড়ে। তখন অবশ্য গ্রামে কংক্রিটের শহিদ বেদী ছিল না, মাটি দিয়ে কাঠ দিয়ে নিজেরাই শহিদ বেদী বানাতাম। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে পড়ার সময়ও ভাষাদিবস পালন করেছি। সেটাও একটা আলাদা আবেগ। সকলের সঙ্গে মিলে রাস্তায় আল্পনা এঁকেছি। সেসব স্মৃতিই এখনও টাটকা। সেসব আমি নিজের মননে সযত্নে লালন করি…’