বাংলা নিউজ > ঘরে বাইরে > Babri Masjid: ৩০ বছর আগের সেই দিনটা

Babri Masjid: ৩০ বছর আগের সেই দিনটা

৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২

কারণ তিরিশ বছর আগে আমি মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সবে উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে। অ্যাডোলেসনকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা এখনও ভ্রু কোঁচকালেই মাথার কোনও এক কোণা থেকে দু-এক কুঁচি স্মৃতি বেরিয়ে আসে।

চিরঞ্জীব পাল

তিরিশ বছর আগেকার কথা। এই তিরিশ বছরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আজকাল তো আবার গঙ্গার জলের মতো বয়ে চলেছে তথ্যের স্রোত। যে স্রোতে মানুষের মন থেকে অবলীলায় ভেসে যায় তিরিশ বছরের ইতিহাস। তবু সেই ইতিহাসকে আজকের দিনে মনে করায় মিডিয়া। তিরিশ আগের বিশ্ব জুড়ে সাড়া ফেলে দেওয়া এক ঘটনা কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকরা কেউ কেউ লিখে ফেলেন সে দিনের আখ্যান।

আমার অবশ্য তার সুযোগ নেই। কারণ তিরিশ বছর আগে আমি মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সবে উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে। অ্যাডোলেসনকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা এখনও ভ্রু কোঁচকালেই মাথার কোনও এক কোণা থেকে দু-এক কুঁচি স্মৃতি বেরিয়ে আসে। সম্পাদকের নির্দেশে সেগুলিকেই তুলে ধারার চেষ্টা এই নিবন্ধে।

অ্যাডোলেসনকালে এক কিশোর তার আদর্শ খোঁজে, মত খোঁজে, জীবনদর্শন খোঁজে। আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। সেই সব খুঁজতে যখন ব্যস্ত, সেই সময় আমি ভর্তি হলাম কলেজ স্ট্রিটের একটি কলেজিয়েট স্কুলের একাদশ শ্রেণিতে। বনহুগলি থেকে কলেজ স্ট্রিট আমার বয়স অনুযায়ী তখন দূরত্বটা অনেক। কিন্তু এই দূরত্বই আমার কাছে সুযোগ এনে দিয়েছিল কলেজ ছুটির পর নিজের মতো খানিকটা সময় কাটানোর। যানজটের অযুহাত দিয়ে এলোপাথারি শহরে মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর। 

এমনই এক সময় এল সেই দিন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। দিনটা ছিল রবিবার। তাই স্কুল ছুটি। উত্তর কলকাতা আর পাঁচটা বাঙালি বাড়ির মতো আমাদের বাড়িতেও সকালে লুচি হত। সেই লুচি খেয়ে ভাইদের সঙ্গে বাড়ির জমিয়ে ক্রিকেট খেলা চলছে। সেই সময় বাবা এসে দেখলাম টিভিটা খুললেন। সঙ্গে তাঁর এক বন্ধু এসেছেন। পাড়ায় তখন হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতে টিভি আছে। সেই তালিকায় আমাদের বাড়িও ছিল। টিভি চলছে দেখে গেলাম। খবর শুনে বুঝলাম এক দল লোক ভেঙে দিয়েছে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ। অদ্ভুত ভাবে বাবার মুখটা পাল্টে গেল। আমাকে বলল, 'রাস্তায় বেরস না। আজ পড়া নেই তো, থাকলে যেতে হবে না।' কিছু পর আমার এক কাকা এসে বললেন, আলমবাজারে গণ্ডগোল হচ্ছে। পরে শুনলাম শুধু আলমবাজার নয় গণ্ডগোল হচ্ছে কলকাতাতেও মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ। কোথায় কোথায়ও ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়েছে। বিকালে বাবা আর দোকান খুললেন না। বাড়িতে তখন শুধুই খবর। তখন তো একটাই চ্যানেল। দূরদর্শন।

পরের দিন সকালে কাগজ এল। লিড স্টোরি বাবরি মসজিদ ভাঙার। পাড়ায় যাঁরা কংগ্রেসী বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা সব দেখলাম ভাঙার পক্ষে কথা বলছেন। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস সরকার, সব ভুলে গিয়ে তাঁরা বলেছেন, ‘যা করেছে ঠিক করেছে। শালারা বড্ড বাড় বেড়েছিল।’ সকালে বামেদের সম্প্রীতি মিছিল বেরলো। কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও একটা মিছিল বার করা হলো। আমার ওই সব পাড়াতুতো কংগ্রেসী কাকারাও হাঁটলেন সেই মিছিলে। অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। তখন পাঠ্য বইয়ে পড়া রবীন্দ্রনাথের সেই লেখা, 'যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না' বড় অমোঘ সত্য মনে হল। তার পর মসজিদ ভাঙা নিয়ে যত আলাপ-আলোচনা চলছিল সবেতেই সেই এক সুর। ভাবনা চিন্তাগুলোকে গুলিয়ে দিচ্ছিল।

আঠাশ বছরের মাথায় রামমন্দির নিয়ে রায় দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। যখন এই রায় দিয়েছে তখন আমি পুরদস্তুর সাংবাদিকতা করছি। রায়ের পর দ্রুত গতিতে মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে। আশপাশের একটি জমির দাম বেড়েছে। তিন তারা, পাঁচ তারা সব হোটেল হচ্ছে , মন্দির দর্শনে এসে ভক্তরা থাকবেন বলে।

গঙ্গার জল বয়ে চলেছে। তথ্যও বয়ে চলেছে স্রোতের মতো। সেই স্রোতে ভেসে যাবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আখ্যান। জেগে থাকবে নবনির্মিত রামমন্দির। কিন্তু মনে যে বিভেদে বসত করে আছে, তা কী ভেসে যাবে সেই স্রোতে? নিদেন পক্ষে সচেতন মন নিয়ে জোর করে ভাসিয়ে দেবে কেউ? না হলে আরও একটা থমথমে দিনে অবিশ্বাসের ইতিহাস লেখা হবে।

বন্ধ করুন