রাহুল সিং
প্রতিপক্ষের সংখ্যা ২৫০-এর বেশি। সেখানে কর্নেল বি সন্তোষ বাবুর নেতৃত্বে ভারতীয় জওয়ান ছিলেন মেরেকেটে ৫০ জন। পরে দু'পক্ষের আরও জওয়ান এলেও চিনারা পাল্লায় এগিয়ে ছিল। সঙ্গে তারা কাঁটা তার, পেরেক নিয়ে প্রস্তুত ছিল। শুধু একটা দিক দিয়েই সেই পরিস্থিতি এগিয়ে ছিলেন সন্তোষ বাবুরা - অদম্য সাহস। আর তাতেই ভর করে সাত ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিজেদের এলাকা ধরে রাখলেন ভারতীয় জওয়ানরা।
আধিকারিকরা জানিয়েছেন, সোমবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ গালওয়ান উপত্যকার ১৪ প্যাট্রোল পয়েন্টের কাছে কর্নেল বি সন্তোষ বাবুর নেতৃত্বে জওয়ানদের একটি দল গিয়েছিল। দু'দেশের প্রোটোকল অনুযায়ী ভারতীয় জওয়ানদের কাছে কোনও অস্ত্র ছিল না। বিতর্কিত সীমান্তে যে জওয়ানরা প্যাট্রোলিং করেন, তাঁদের বন্দুক নেন না। যদিও বা বন্দুক থাকে, তাহলে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখেন। বন্দুকের ম্যাগাজিনও পাউচে রাখা থাকে। বন্দুকে লাগানো থাকে না।
গত ৬ জুন দু'দেশের উচ্চপদস্থ কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সেই এলাকা থেকে পিছিয়ে যাওয়ার কথা ছিল চিন সেনার। বৈঠকে ভারতীয় সেনার ১৪ কর্পস কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল হরিন্দর সিং ছিলেন। চিনের তরফে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন দক্ষিণ শিনজিয়াং সামরিক এলাকার মেজর জেনারেল লিউ লিন। এক আধিকারিক জানান, বৈঠক অনুযায়ী ওই এলাকার পূর্বে পাঁচ কিলোমিটার পিছিয়ে যাওয়ার কথা ছিল চিনা সেনার। গত সপ্তাহে তারা কিছুটা সরে গিয়েছিল। কিন্তু সাময়িকভাবে যে জায়গাগুলি দখল করেছিল, সেগুলি নিতে আবারও ফিরে আসে।
অপর আধিকারিক বলেন, 'কিন্তু ভারতীয় দল চিনা বাহিনীকে দেখতে পায়। যা ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন। তারা পিছিয়ে যায়নি এবং তাদের তাঁবু ও একটি নজরদারি পোস্ট আশপাশে ছিল।' ওই এলাকায় উপস্থিতি নিয়ে চিনা সেনাদের চেপে ধরেন কর্নেল বাবু এবং তাঁর দল। তা সংঘর্ষে গড়ায়। কিন্তু চিনা সেনা সেখান থেকে চলে যেতে অস্বীকার করে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা এপারে হওয়ায় চিনাদের নজরদারি পোস্ট এবং তাঁবু সরিয়ে দেন ভারতীয় জওয়ানরা। তারপর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় আধিকারিক বলেন, 'কিন্তু চিনারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকছিল। মনে হচ্ছে, ওরা সংঘাতের জন্য প্রস্তুত ছিল।'
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন দু'দেশের সৈনিকরা। সাত ঘণ্টা ধরে চলে সেই সংঘর্ষ। তাতে দু'পক্ষের আরও জওয়ান যোগ দেন। ১৪ প্যাট্রোল পয়েন্ট থেকে যে সংঘর্ষ শুরু হয়, তা নিকটের একটি নদীর তীরে অবস্থিত সরু পাহাড়ের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেই হতাহত হন জওয়ানরা। দু'পক্ষের ফৌজিরাই ঘুষি চালান, একে অপরকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়েন। নৃশংসভাবে ভারতীয় জওয়ানদের উপর লোহার রড, পেরেকের মতো ধারাল কাঁটা দিয়ে হামলা চালায় চিনা সেনা। কয়েকজন জওয়ান জলে পড়ে যান। তাঁদের দেহ মঙ্গলবার সকালে উদ্ধার করা হয়।
আধিকারিকরা জানিয়েছেন, সোমবার রাতে প্রাথমিকভাবে সংঘর্ষে কর্নেল সন্তোষ বাবু এবং দুই জওয়ান মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁরা সেই রাতেই মারা যান। এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে আরও ভারতীয় জওয়ান আসেন এবং মধ্যরাত পর্যন্ত সেই সংঘর্ষ চলে। তৃতীয় আধিকারিক জানান, সংঘর্ষে দু'পক্ষের ৫০০-র বেশি জওয়ান ছিলেন।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে ২০ জন ভারতীয় জওয়ানের মৃত্যু হয়। চিনের তরফে হতাহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৪০-৪৫। অথচ সেদিনই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর দুটি জায়গায় ভারতীয় এবং চিনা সেনার আধিকারিকরা বৈঠক করেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার পর্যায়ের বৈঠকটি হয়েছিল গালওয়ান উপত্যকায় এবং হটস্প্রিংয়ে কর্নেল পর্যায়ের বৈঠকটি হয়েছিল। তার কয়েক ঘণ্টার পর সংঘর্ষের কারণে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘর্ষে সর্বকালীন নীচে নেমে গিয়েছে।