রবিবার দুপুর। মাথার উপর সূর্য তেজ বাড়িয়ে উপস্থিত। আর গোটা কলকাতা তখন থমকে। থিক থিক করছে মানুষের ভিড়। এক মনে কথা শুনছেন সবাই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর। ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে তখন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। তারপর হঠাৎ সব চুপচাপ। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢেকে নিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে। হ্যাঁ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করলেন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের। সেই প্রার্থী তালিকায় অন্যতম চমক হল—পদ্মশ্রী কালীপদ সোরেন। যাঁকে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করা হয়েছে। এটা শোনার পরই করতালিতে মেতে ওঠেন আদিবাসী মানুষজন। এই কালীপদ সোরেন ২০২২ সালে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান পেয়েছিলেন। আর ফেব্রুয়ারি মাসেই জঙ্গলমহল সফরের শেষদিনে ঝাড়গ্রামে প্রশাসনিক সভায় কালীপদ সোরেনের হাতে বঙ্গবিভূষণ তুলে দিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
এদিকে যাঁরা চেনেন না তাঁরা খুঁজতে থাকেন—কে এই কালীপদ সোরেন? তখন উঠে আসে, সাঁওতালি সাহিত্যজগতের ‘নক্ষত্র’ এই কালীপদ সোরেন। তাঁকে বেশিরভাগ মানুষই খেরওয়াল সোরেন নামেই চেনেন। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এই নামেই সাহিত্যচর্চা করেছেন তিনি। ১৯৫৭ সালে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রামের মহকুমার রঘুনাথপুরে জন্ম সাহিত্যিক কালীপদ সোরেনের। এখন তাঁর বাড়ি ঝাড়গ্রাম শহরের ভরতপুরে। সেখানকার স্কুল থেকে ১৯৭৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন কালীপদ। তারপর তিনি ভর্তি হন কাবগাড়ির সেবাভারতী কলেজে। সেখান থেকেই স্নাতক হন ১৯৮১ সালে। এরপর ১৯৮৪ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাশ করেন কালীপদ সোরেন।
আরও পড়ুন: সৌমেন্দুর প্রচারসভায় পুলিশের উপর হামলা করল বিজেপি, খেজুরিতে তুমুল উত্তেজনা
অন্যদিকে তখন থেকেই সাহিত্য চর্চা এবং নানা লেখালিখির কাজ করতে থাকেন। ওই সময়ই ‘রিমিল’ নামের একটি সাঁওতালি পত্রিকার সম্পাদনার করেন কালীপদ সোরেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেই পত্রিকায় তিনি সম্পাদনা করেছেন। সাহিত্যিক কালীপদ চাকরি পান একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে। সেই সুবাদে প্রথমে তিনি আসেন কলকাতায়। কিন্তু কলকাতায় নিরিবিলি জায়গা খুঁজে পাননি তিনি। তাই ঝাড়গ্রামে বদলি নিয়ে চলে যান। দীর্ঘ ৩৩ বছর চাকরি করেন। কিন্তু কোনও প্রমোশন নেননি কালীপদ সোরেন। শুধুমাত্র সাহিত্য চর্চার জন্যই নিজেকে একজায়গায় আটকে রাখেন। তবে কলকাতায় থাকার সময় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জন্য একটি নাট্যদল তৈরি করেন।
এছাড়া নানা লেখালিখি তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলতে থাকে। তাই তো ২০০৭ সালে তাঁর ‘চেৎরে চিকায়েনা’ নাটকের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পান কালীপদ সোরেন। এখানেই শেষ নয়, ২০১৯ সালে দিব্যেন্দু পালিতের বাংলা উপন্যাস ‘অনুভব’ সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করে কালীপদ সোরেন সাড়া ফেলে দেন গোটা রাজ্যই। আদিবাসী ও সাঁওতালদের হৃদয়ে চিরতরে জায়গা করে নেন কালীপদ সোরেন। তাই আবারও সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার জোটে তাঁর। পর পর সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পেয়ে প্রান্তিক ঝাড়গ্রাম থেকে উঠে আসেন সবার সামনে। তাছাড়া সাঁওতালি লেখক সংগঠনের পুরষ্কার, রঘুনাথ মুর্মু ফেলোশিপ, অনগ্রসর কল্যাণ বিভাগের পুরষ্কার তো তাঁর ঝুলিতে আছেই। ২০২২ সালে পদ্মশ্রী পুরষ্কার পান কালীপদ সোরেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে। আর ২০২৪ সালে কালীপদ সোরেন পান রাজ্য সরকারের পুরষ্কার ‘বঙ্গবিভূষণ’। এখন আবার তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভার প্রার্থী।