স্কুলে সরস্বতী পুজো পুনরায় চালু করার দাবি তোলায় মার খেলেন পড়ুয়ারা! অন্য কোনও রাজ্য নয়, খাস পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষী থাকল এই ঘটনার। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে শুক্রবার স্থানীয়দের হাতে মার খেলেন পড়ুয়ারা। সরস্বতী পুজো হোক এই দাবিতে রাস্তা অবরোধ করেছিলেন তারা। তখনই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। চলতি মাসের ২৯ তারিখ বিদ্যার দেবীর আরাধনায় মাতবে গোটা রাজ্যে। এবারও সম্ভবত ব্রাত্য থাকবে বসিরহাটের চৌহাটা আদর্শ বিদ্যাপিঠ।
জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালের পর এই স্কুলে সরস্বতী পুজো হয়নি।স্থানীয়দের চাপেই সরস্বতী পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।। হারোয়া পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত এলাকায় অবস্থিত এই স্কুলে প্রায় ১৭০০ ছাত্র-ছাত্রী পড়েন। অধিকাংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের।যদিও অধিকাংশ শিক্ষক হিন্দু।এদিকে জুনিয়র সেকশনের কিছু ছেলে ও মেয়ে চাইছিল যে আবার শুরু হোক বিদ্যাদেবীর আরাধনা। ইংরেজি পড়ান এক শিক্ষকও পড়ুয়াদের এই দাবিকে সমর্থন করেন।
কিন্তু এই দাবিতে পথ অবরোধ শুরু হতেই চড়াও হন স্থানীয়রা। পাঁচজন পড়ুয়া আহত। নিশানা করা হয় সেই সমর্থনকারী শিক্ষককেও। তাঁকে কোনও রকমে বাঁচান অন্যান্য শিক্ষকরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, মারের চোটে পড়ুয়াদের হাত-পা থেকে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল। তবে হাসপাতালে ভর্তি হননি কেউ। এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
বছরের জুনে হেডমাস্টার হয়ে স্কুলে যোগ দিয়েছেন হিমাংশু শেখর মণ্ডল। এই ঘটনায় কার্যত নিজের অসহায়তা ব্যক্ত করেছেন তিনি। হিমাংশুবাবুর কথায়, ' আমি সদ্য জয়েন করেছি। যখন আগের কথা শুনলাম, মনে হল জটিল পরিস্থিতিতে পুজো বন্ধ হয়েছিল। আবার শুরু হলে ঝামেলা লাগতে পারে বলে মনে হল। তাই আমি ম্যানেজিং কমিটিকে জিজ্ঞেস করি। তারা বলে যে নিরাপত্তার কথা বিচার করে, কোনও সিদ্ধান্তে তারা আসতে পারেনি।' সরস্বতী পুজো হবে কিনা, সেটা বলতে পারেননি হেডস্যার।
হেডস্যার জানান যে ২০০৯ সালে নবি দিবস পালন করতে হবে স্কুলে, এই নিয়ে শুরু হয়েছিল উত্তেজনা। রফা স্বরূপ ঠিক হয়ে যে সরস্বতী পুজো ও নবি দিবস, উভয়ই হবে না স্কুল চত্বরের ভিতরে।
হিমাংশুবাবু বলেন যে আশা করি সোমবার নতুন করে গণ্ডগোল লাগবে না। শুক্রবার কেউ বাইরে থেকে স্কুলের দরজা আটকে দেয় বলে জানান তিনি। এরপর বাইরে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে, ব্যাহত হয়ে ট্র্যাফিক চলাচল। পড়ুয়ারা ভিড়ে চাপা পড়ে আহত হয়েছেন বলে হেডস্যারের দাবি। তিনি কোনও পড়ুয়াকে মার খেতে দেখেননি, বলে জানিয়েছে হিমাংশুবাবু।তাঁর কথায় ভিতরে কোনও কিছু হয়নি, অস্থিরতা ছিল বাইরে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে স্থানীয়রা শুধু যে পড়ুয়াদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন তা নয়, তারা স্কুলের ভিতরেও ঢুকে পড়েন জনৈক ইংরেজি শিক্ষক গণেশ সর্দারের ওপর হামলা করতে, যিনি পুজো আবার করে শুরু করতে চেয়েছিলেন। অন্য টিচাররা মহিলাদের বাথরুমে লুকিয়ে রাখেন গণেশবাবুকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ অফিসার HT কে জানিয়েছেন যে সেই মুহূর্তে প্রচন্ড উত্তেজনা ছিল অঞ্চলে। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গিয়েছে।
এই ঘটনায় দৃশ্যতই বিচলিত গণেশ সর্দার। তিনি জানান যে পঞ্চাশ বছর ধরে সরস্বতী পুজো হচ্ছিল স্কুলে। ২০০৯ সালে বন্ধ হয়। তবে স্থানীয় পুলিশকে তাঁর প্রাণ বাঁচানোর জন্য কৃতিত্ব দেন তিনি। সময় মতো জেলা প্রশাসন ও পুলিশ না এলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হত বলে তাঁর আশঙ্কা। হারোয়া থানার অফিসার-ইন-চার্জ তাঁকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন বলে জানান গণেশবাবু। আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক সংগঠনের তিনি জেলা সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় হামলাকারীরা তাঁকে বেছে নেয় বলেও অভিযোগ ইংরেজি শিক্ষকের।গণেশবাবু জানান যে তিনি সরস্বতী পুজো ও নবি দিবস, উভয় চালু করার জন্য সওয়াল করেছিলেন।
হারোয়া থানার পুলিশ-ইন-চার্জ শংকর সিনহা অবশ্য এই ঘটনা নিয়ে বিষদে কিছু বলতে চাননি। শনিবার রাতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন যে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ২০১৭ সালে এক ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটে বসিরহাট ও বাদুরিয়া অঞ্চলে। অনেক দোকান-পাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত বিগত কিছু বছর ধরেই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ বিভিন্ন জনসভায় বলে আসছেন যে বাংলায় সরস্বতী ও দুর্গাপুজো করার ওপর বাধা দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য রাজ্য প্রশাসনকে দুষেছেন তাঁরা। অমিত শাহ এটিও বলেন যে এই পুজোগুলি যদি ভারতে না হয়, তাহলে কী পাকিস্তানে গিয়ে করা হবে?
শুক্রবারের এই ঘটনার কড়া নিন্দা করা হয়েছে বিজেপির তরফ থেকে।বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেন যে এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তাঁর কথায়, উত্তর ২৪ পরগণা একাংশ বেআইনি অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গিয়েছে। শুক্রবারের ঘটনা তারই প্রমাণ বলে সায়ন্তন বসুর দাবি। মন্ত্রী তথা তৃণমূল জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন যে তিনি ঘটনাটির বিষয়ে জানেন না। না জেনে কোনও মন্তব্য করবেন না।