যে পথ ধরে মিমি, নুসরত, দেবরা আজ সাংসদ, বঙ্গরাজনীতির সেই ধারার সূত্রধর ছিলেন তাপস পাল। পর্দা থেকে সরাসরি রাজনীতিতে ঝাঁপ, বঙ্গ রাজনীতিতে এমন নজির তেমনটা ছিল না তার আগে। ২০০১ সালে যখন তাপস পাল তৃণমূলে যোগ দেন তখন তৃণমূল সবে হাঁটি হাঁটি পা পা। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ৮টি আসন জিতলেও সাংগঠনিক ক্ষমতায় তখনও বামেদের থেকে কয়েক মাইল পিছিয়ে তারা তৃণমূলের সেই শুরু দিনের সৈনিক তাপসের গ্রেফতারির পর তেমন কোনও হেলদোল ছিল না মমতার, এমন অভিযোগও ছিল তাঁর। পর্দা থেকে বিধানসভা, সংসদ হয়ে ভুবনেশ্বরের বন্দিজীবন। চলচ্চিত্রের মতোই বৈচিত্রময় তাপস পাল।
২০০১ সালে তাপস পালকে কলকাতার আলিপুর কেন্দ্র থেকে টিকিট দেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন সবে রাজনীতিতে হাতে খড়ি হচ্ছে তাঁর। দলনেত্রীকে নিরাশ করেননি তাপস। তৎকালীন বাম বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটিতে তৃণমূলকে উতরে দিয়েছিলেন তিনি। ২০০৬ সালেও ফের ওই আসন থেকেই ভোটে দাঁড়ান তাপস পাল। তাঁকে বেগ দিতে সেখানে অভিনেতা বিপ্লব চক্রবর্তীকে ময়দানে নামিয়েছিল বামেরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রায় ১০০০০ ভোটে ফের আলিপুর আসনে জেতেন তাপস পাল।
২০০৯ সালে সিঙুর আন্দোলনের পর তৃণমূলে প্রোমোশন হয় তাপসের। কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে তাঁকে লোকসভা নির্বাচনের টিকিট দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন সিপিএমের জ্যোতির্ময়ী শিকদার ও বিজেপির সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। জ্যোতির্ময়ীকে হারিয়ে আসনটি ছিনিয়ে নেন তাপস। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনেও ওই আসন থেকে প্রার্থী হন তাপস। বাম বিজেপির ভোট কাটাকাটিতে সেবারও বাজিমাত করেন তিনি। ১০ বছরের সংসদীয় জীবনে একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পর নদিয়ার নাকাশিপাড়ার মাখড়া গ্রামে বিতর্কে জড়ান তাপস পাল। একটি ভাইরাল ভিডিয়োয় তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘সিপিএমের লোকেরা আমাদের কর্মীদের ওপর নির্যাতন করলে বাড়িতে ছেলে ঢুকিয়ে দেব। রেপ করে চলে যাবে।‘ তাপসের এই মন্তব্যে শুধুমাত্র তাঁর দল নয় বিড়ম্বনায় পড়ে তাঁর পরিবারও।
সাংসদ থাকাকালীন বেআইনি আর্থিক সংস্থা রোজভ্যালির সঙ্গে জড়ান তাপস। রোজভ্যালির চলচ্চিত্র শাখার নির্দেশক ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে রোজভ্যালিকাণ্ড প্রকাশ্যে এলে তদন্তে উঠে আসে তাঁর নামও। দফায় দফায় জেরার পর ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাপসকে গ্রেফতার করে সিবিআই। ১৩ মাস জেলবন্দি থাকার পর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পান তিনি। জেলে থাকাকালীনই স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হন তাপস পাল। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে বন্দিদশাতেই তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে।
জেল থেকে মু্ক্তি পেয়ে মাখড়ায় করা বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চান তাপস। তবে তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে তাঁর। সাংসদ হিসাবেও ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তবে দলের বিরুদ্ধে কখনও কোনও মন্তব্য করেননি তাপস পাল। বরং বলেছেন, আমি জানি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় আমার পাশে আছেন।
মঙ্গলবার ভোর রাতে মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে তাপস পালের। বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। রইলেন স্ত্রী নন্দিনী, কন্যা সোহিনী।