শনিবার সন্ধ্যায় রাজভবনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মমতার সাক্ষাতের পর থেকেই নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে মোদী - মমতা ‘সেটিং’-এর তত্ত্ব। বাম – কংগ্রেসের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেপি বিরোধিতা পুরোটাই লোক দেখানো। আসলে একে অপরকে জায়গা করে দিতে এতটুকু আপত্তি নেই বিজেপি ও তৃণমূলের।
শনিবার CAA ও NRC বিরোধী ব্যাজ পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত একান্ত বৈঠক যোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠক ছিল একান্ত। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে তা জানেন না কেউ। বৈঠক সেরে বেরিয়ে মমতা জানান, রাজ্যের প্রায় ৩৮,০০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে কেন্দ্রের কাছে। তাছাড়া আমরা CAA ও NRC প্রত্যাহার চাই, সেকথা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। মানুষে মানুষে বৈষম্য হওয়া উচিত হয়। কোনও মানুষ যাতে দেশ থেকে বাদ না পড়ে। মানুষের ওপর অত্যাচার হওয়া উচিত নয়। CAA ও NRC নিয়ে আপনাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করুন।‘ মমতা জানান, ‘জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, আর্থিক পাওনা গন্ডার ব্যাপারটা কাগজপত্র দেখে মিটিয়ে দেবেন তিনি। আর CAA ও NRC নিয়ে দিল্লিতে গেলে সুযোগ হলে আলোচনা হবে।’ এর পর ধর্মতলায় TMCP-র ধরনা মঞ্চে যান মমতা। সেখানে আগে থেকেই বামপন্থী পড়ুয়াদের বিক্ষোভ চলছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেখানে পৌঁছতেই শুরু হয় ‘মোদীর দালাল ছিঃ ছিঃ’ স্লোগান।
শনিবারের মোদী-মমতা বৈঠক নিয়ে ফের বোঝাপড়ার অভিযোগে সরব হয়েছে বাম ও কংগ্রেস। বিজেপির দাবি, নিছকই সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। একই দাবি তৃণমূলেরও। তবে তা মানতে নারাজ বাম ও কংগ্রেস।
বাম – কংগ্রেসের দাবি, মমতার NRC বিরোধিতায় খাদ না-থাকলে সোমবার দিল্লিতে বিরোধীদের বৈঠক কেন বয়কট করলেন তিনি? যে অছিলায় মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কি হাস্যকর নয়? বনধে বিরোধীরা হিংসা ছড়িয়েছে বলে দাবি করে CAA বিরোধী বৈঠকে গরহাজির থাকা আর চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার ফারাক কী?
শুধু তাই নয়, গত ১০ ডিসেম্বর লোকসভায় CAA নিয়ে ভোটাভুটির দিন হুইপ জারি সত্বেও সেখানে গরহাজরি ছিলেন তৃণমূলের ৮ সাংসদ। তার মধ্যে বেশ কয়েকজন অভিনেতা সাংসদ সেদিন শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। এমনকী সেদিন লোকসভায় হাজির না থাকা ভুল হয়েছিল বলে স্বীকার করেছেন ঘাটালের তৃণমূল সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে অভিনেতা দেব। প্রশ্ন উঠছে, তার পর এই সাংসদদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস? উত্তর সবার জানা।
শুধু তাই নয়, গত ১ জানুয়ারি বাম শাসিত কেরল বিধানসভায় পাশ হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী প্রস্তাব। CAA-র বিরোধিতায় তেমনই প্রস্তাব এরাজ্যের বিধানসভাতেও পাশের দাবি তোলে বাম ও কংগ্রেস। গত ৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনের আগে বিজনেস অ্যাডভাইজারি কমিটির বৈঠকে এই প্রস্তাব দিলে পদ্ধতিগত কারণ দেখিয়ে তা খারিজ করে দেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম – কংগ্রেসে অভিযোগ, তৃণমূলকে সরকারি প্রস্তাব পেশেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অর্থৎ CAA বিরোধী প্রস্তাব বিধানসভায় পেশ করবে সরকার, তাকে সমর্থন করবে অন্য দলগুলি। তাও মানেনি তারা।
গত ৮ জানুয়ারি বাম – কংগ্রেসের ডাকা বনধের বিরোধিতা করেছে তৃণমূল। এমনকী ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধীদের বনধকে পণ্ড করতে সরকারি কর্মীদের ওপর সামন্ততান্ত্রিক হুলিয়া জারির যে অভ্যাস মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, এই বনধেও তার ব্যতিক্রম ঘটাননি তিনি। যে নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা রয়েছে, বনধের দিন গরহাজির থাকলে মিলবে না ছুটি। কাটা যাবে বেতন। এমনকী কর্মজীবনেও ছেদ পড়তে পারে। যার ফলে আগের রাতে বাড়ি ফিরতে পারেননি বহু সরকারি কর্মী। এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আবার গত রবিবার দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐশী ঘোষদের ওপর দুষ্কৃতী হামলাকে ‘ফ্যাসিস্ত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বলে নিন্দা করেছিলেন।
প্রশ্ন উঠছে, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের CAA বিরোধিতার সারবত্তা কতটুকু? কারণ মুখে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতার করা বলে পথে নামলেও কার্যকরী কোনও পদক্ষেপ করেননি তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উলটে লোকসভায় ৮ তৃণমূল সাংসদ গরহাজির থাকায় সুবিধা হয়েছে বিজেপিরই। বিরোধীদের সোমবারের বৈঠকে মমতা হাজির না থাকলে ফের একবার ফোকলা হাসি হাসবে এদেশে বিরোধী ঐক্য।
যে প্রদেশ কংগ্রেসকে পাত্তাই দেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যে সিপিএম সাইনবোর্ড হয়ে গিয়েছে বলে দাবি তাঁর, তারা কোথায় কী করল সেজন্য কেন আটকে যাবে বিরোধীদের বৈঠকে তাঁর যোগদান? ২০১১ সালের পর থেকেই যিনি নিজেকে জাতীয় স্তরের নেত্রী প্রমাণ করতে মরিয়া, কয়েকটা আঞ্চলিক দল কী করল তাতে কেন বদলাবে তাঁর কর্মসূচি?
দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেন তাঁরা বলছেন, নীতিহীন রাজনীতি, সুবিধাবাদ, একনায়কতন্ত্র ও উগ্রতাই মমতার বৈশিষ্ট্য। যে বিজেপির হাত ধরে মমতার দলের উত্থান, তারাই এখন মমতার চক্ষুশূল। শুধু তাই নয়, সবার কাছে নিজের আন্দোলনের জন্য সমর্থন চাইলেও কাউকে তার কৃতিত্ব দিতে নারাজ তিনি। সিঙুর নন্দীগ্রাম পর্ব তার জ্বলন্ত নির্দশন। অন্যের গুড় খেয়ে আসবেন, কিন্তু নিজের গুড় অন্যে খাওয়া তো পরের কথা, মাছি বসতেই দেবেন না তিনি। যাই হোক না কেন, তিনিই যে সর্বেসর্বা তা নিয়ে যেন প্রশ্ন তুলতে না পারে কেউ।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আনুষ্ঠানিক বৈঠকে যোগ দিতে এত ভয় কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? সংসদ হোক বা বিধানসভা, নানা অছিলায় কেন তিনি আনুষ্ঠানিক বৈঠক এড়ান তিনি? বিশেষজ্ঞদের মতে, মমতার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে অস্বীকার করার রাজনীতি (Politics of denial)। আনুষ্ঠানিক বৈঠকে সমস্ত বক্তার যাবতীয় বক্তব্য লিপিবদ্ধ থাকে। ফলে পরে কোনও ভাবেই নিজের বক্তব্য বদলাতে পারেন না বক্তা। সংসদে সমস্ত বক্তার প্রত্যেকটি শব্দ লিপিবদ্ধ হয়। একই ভাবে লিপিবদ্ধ হয় বিধানসভাতেও। যা পরে কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
একাধিক পক্ষের সঙ্গে বৈঠক (যেমন সোমবারের বিরোধীদের বৈঠক) করলেও পরে বক্তব্য বদলানো মুশকিল। সেক্ষেত্রে অন্যান্য পক্ষ বক্তব্য বদলের পর সরব হতে পারে। এসব ঝঞ্ঝাটেই যেতে চান না তৃণমূলনেত্রী। সুবিধামতো নিজের বক্তব্য বদলে ফেলতে ওস্তাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে যে কোনও মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করতে পারেন তিনি। আর সেই পথ সব সময় খোলা রাখতে তৎপর তিনি।
তাই যে বিজেপির সঙ্গে জোট করে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান এখন তারাই তাঁর প্রধান শত্রু। আবার যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধিতার জেরে নতুন দল গড়েছিলেন তিনি তাদের সঙ্গে একাধিক নির্বাচনে জোট করেন মমতা। এমনকী কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে তাদের কী অবস্থা করেছিলেন সে ইতিহাস সবার জানা।
এরই সঙ্গে রয়েছে আর্থিক কেলেঙ্কারির চাপ। দলের একাধিক নেতা, বিধায়ক ও সাংসদের বিরুদ্ধে সারদা ও রোজভ্যালির তদন্ত চলছে। এমনকী সিবিআইয়ের নজর রয়েছে তাঁর বাড়িতেও। যা নিয়ে মাঝেমাঝেই হুঙ্কার ছেড়ে থাকেন বিজেপি নেতারা। সব মিলিয়ে মুখে হালুম হুলুম করলেও বিজেপির বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনও পদক্ষেপ করার ক্ষমতা নেই মমতার।
আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী, জয়ললিতা, লালুপ্রসাদের মতো রাজনীতিবিদের মূল পুঁজি গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতা। এদেশে চিৎকার করে কেউ কিছু বললেই মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। তাই মমতার মুখে CAA বিরোধিতার স্লোগানই তাঁকে বিশ্বস্ত করে তোলে। সংসদ বা বিধানসভায় তাঁর বা তাঁর দলের পদক্ষেপ নয়। যদিও সভ্য সমাজের তা রীতি অন্য। তাই এখনো সংসদ বা বিচারালয়ে গলার জোরকে দমিয়ে রাখে শানিত যুক্তি, এই যা বাঁচোয়া।