ও তো খুব ভালো ছেলে, ও এরকম করতে পারে না; ও এরকম কাজ কীভাবে করল- যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্মান্তিক ঘটনায় অভিযুক্তদের দেখে কেউ-কেউ হয়ত সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। আর অনেক সময় সেইসব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ছোটবেলার উপর। যাদবপুরকাণ্ডে ধৃতদের ক্ষেত্রে ঠিক কী হয়েছিল, সেটা হলফ করে বলা মুশকিল। সেটার জন্য সকলের সঙ্গে খুঁটিয়ে কথা বলতে হবে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের বিকাশের সময় তাদের অবচেতন মনে ধীরে-ধীরে একটা র্যাগিংয়ের বিষবৃক্ষ বাড়তে থাকে। সেটা হয়ত সরাসরি র্যাগিং নয়। কিন্তু র্যাগিংয়ের মতোই একটা বিষয়।
বিষয়টি ঠিক কীরকম? ছেলেবেলায় বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মজা, খেলাধুলো হয়। দেদার দুষ্টুমিও চলে। সেই নিখাদ দুষ্টুমি যদি দুষ্টুমির পর্যায় থাকে, তাহলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু কোনও বাচ্চা যদি এমন কোনও কাজ করে, যা অপর কোনও বাচ্চার পক্ষে ক্ষতিকারক হয় বা অপর বাচ্চাকে দমিয়ে রাখার মতো কাজ হয় বা অন্যদের ছোট করা হয়, সেটা একটা বিপদ সংকেত। সেক্ষেত্রে অতি অবশ্যই বাবা-মা'কে হস্তক্ষেপ করতে হবে। কারণ সেটার মধ্যে ভবিষ্যতের র্যাগিংয়ের বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে।
বাবা-মা যদি সেখানেই সন্তানের ভুল শুধরে না দেন, তাহলে ওই বাচ্চার অবচেতন মনে একটা ধারণা তৈরি হবে যে সে যে কাজটা করছে, সেটা ঠিক করছে। অন্যকে উপহাস করে ঠিক কাজ করছে। আর সেই বিষবৃক্ষ ক্রমশ বাড়তে-বাড়তে এমন হয়ে যাবে যে তখন কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। যে বয়সে বাচ্চাকে যেটা শেখানোর দরকার, সেটা শেখানো না হলে পরবর্তীতে তার মধ্যে একটা চূড়ান্ত জেদ তৈরি হয়ে যাবে। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাবে যে বাচ্চাটাকে আর কোনওরকমভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। তাই কোনও বাচ্চা যদি এরকম ব্যবহার করে, অন্যদের ছোট করে কথা বলে, অসম্মান করে, তাহলে বাবা-মা হিসেবে কোনওমতেই ব্যাপারটা হালকা চালে নেওয়া যাবে না। স্রেফ মজা হিসেবে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলে আদতে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যেতে পারে। নিজের সন্তানের জন্যই বিপদ ডেকে আনতে পারেন।
সন্তানের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাবা-মা'র ভূমিকা নিয়ে এটা তো একটা দিক গেল। আবার যারা র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে, তাদেরও সেই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার জন্য বাবা-মা'র ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে, যাতে সে বলতে পারে যে কী কী অসুবিধা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই দূরে থাকা সন্তানদের মনে একটা ধারণা থাকে যে বাবা-মা দূরে আছেন, ওদের এই সমস্যাগুলোর বিষয়ে বলব না। তাহলে ওঁরা চিন্তা করবেন। সেই ব্যাপারটাও যাতে না হয়, সেজন্য সন্তানকে বোঝাতে হবে। যাদবপুরের ঘটনার পর তো আরও খোলাখুলি কথা বলতে হবে। কারণ যাদবপুরের পড়ুয়া তো বটেই, যারা অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের মনেও একটা আতঙ্ক চেপে বসতে পারে।
এক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে বাবা-মা'কে। আমরা অনেক সময় সন্তানদের বলে থাকি যে তোমার সঙ্গে বড়রা যা করছে, সেটা মেনে নাও। এটা কিন্তু আমাদের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মতো হয়ে গিয়েছে। অপমান করলেও বেশি কিছু বল না বাবা। নিজের মতো থাক। অন্যায় দেখলেও আওয়াজ তুলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে- সেই ভাবনাটা অনেকের মধ্যেই ঢুকতে দেওয়া হয় না। কিন্তু সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের প্রতিবাদের ভাষা শেখাতে হবে। সেটা শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলে নয়, ছোট থেকেই সন্তানদের সেটা শেখাতে হবে বাবা-মা'কে।
আর পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে বলতে চাই যে, যেখানেই অন্যায় হোক না কেন, প্রতিবাদ করতে হবে- সেটা শারীরিক নির্যাতন হোক বা মানসিক নির্যাতন হোক। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে র্যাগিং পুরোপুরি বেআইনি। তাই হাতে আইনও আছে। সেইসঙ্গে নিজের পরিবার, ভালো বন্ধু বা ইমোশনালি যাঁর সঙ্গে বেশি জড়িত আছেন, তাঁদের সঙ্গে এরকম র্যাগিংয়ের কথা ভাগ করে নিতে হবে। মনের মধ্যে চেপে রাখলে হবে না। কারণ তাতে সমস্যা মিটবে না। বরং আরও বাড়বে।
তাই যারা ভাবছে যে বাবা-মা'র সঙ্গে র্যাগিংয়ের কথা ভাগ করে নিলে তাঁরা কষ্ট পাবেন, আমি কষ্টে আছি ভেবে বাবা-মা কষ্ট পাবেন - এরকম ভাবনা যারা ভাবছে, তাদের অতি অবশ্যই সেই ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে। সাহায্য নিতে হবে পরিবারের। কাছের মানুষদের মুখ খুললে প্রথমে যদিও বা তাঁরা কষ্ট পান, ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট পড়ুয়া এবং তাঁর পরিবারও সুখে থাকবে।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখকের মতামত ব্যক্তিগত, তা হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার মতামত নয়।)