উত্তরের জেলা উত্তর দিনাজপুর জেলার বৃহৎ অংশ জুড়ে রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রটি বর্তমানে অবস্থান করছে। রায়গঞ্জ শহরে রয়েছে লোকসভা কেন্দ্রের সদর দফতর। এই কেন্দ্রটি তফশিলি জাতি/ তফশিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত নয়। রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র হল ইসলামপুর, গোয়ালপোখর, চাকুলিয়া, করমদিঘি, হেমতাবাদ, কালিয়াগঞ্জ এবং রায়গঞ্জ। এই বিধানসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে করমদিঘি এবং রায়গঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রদুটি কেবলমাত্র সংরক্ষণহীন। বাকি পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রেই তপশিলি জাতি কিংবা উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই কেন্দ্রে বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি টক্কর হয়েছিল। পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেস এবং সিপিআইএম দল দুটিও তাদের হেভিওয়েট প্রার্থী দিয়েছিল এই কেন্দ্রে। জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দীপা দাসমুন্সি, সিপিআইএমের পক্ষ থেকে মহম্মদ সেলিম, তৃণমূলের পক্ষ থেকে কালাইলাল আগরওয়াল এবং বিজেপির পক্ষ থেকে এই কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছিলেন দেবশ্রী চৌধুরী। ২০১৯ লোকসভায় প্রায় ৮০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ এই কেন্দ্রে ভোটদান করেছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ভারতীয় জনতা পার্টির দেবশ্রী চৌধুরী প্রায় ২১ শতাংশ অধিক ভোট পেয়ে এই কেন্দ্র থেকে জয় লাভ করেন। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের কানাইলাল আগরওয়াল।
এবার যদিও অনেকটাই রণনীতি বদলেছে সব দলই। সিটিং সাংসদকে রায়গঞ্জ থেকে টিকিট দেয়নি বিজেপি। তার জায়গায় আস্থা রাখা হয়েছে কার্তিক পালের ওপর। অন্যদিকে হাল আমল অবধি বিজেপিতে থাকা কৃষ্ণ কল্যাণী দল বদলেই পেয়েছেন তৃণমূলের টিকিট। কং-বাম জোটের প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ে আছেন আলি ইমরান রামজ ওরফে ভিক্টর। ভিক্টর কিন্তু সহজে মাঠ ছাড়ছেন না, যে কারণে প্রচারে এসে তাঁকেও আক্রমণ করতে হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রায়গঞ্জ আসনে বিজেপির হয়ে জনসমর্থন কুড়োতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এসেছিলেন, যা নিশ্চিত ভাবেই গেরুয়া শিবিরের মনোবল বৃদ্ধি করেছে। দ্বিতীয় দফায় ২৬ এপ্রিল ভোটদান এই কেন্দ্রে।
১৯৬২ সাল থেকে রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল দেখে নেওয়া যাক এক নজরে। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিকে ছাড়িয়ে আমরা যদি ইতিহাসের দিকে চোখ রাখি, ১৯৬২ লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে চপলাকান্ত ব্যানার্জি। তিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রায় ২৯ হাজার ৪০০ ভোটে পরাজিত করেছিলেন। এরপরে ১৯৬৭ লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জ কেন্দ্রে ফের জয়লাভ করেন চপলাকান্ত ব্যানার্জি, তবে মাত্র ৯৯০ ভোটে জয়লাভ করেন তিনি। ১৯৭১ সালেও এই আসনটি থাকে কংগ্রেসের দখলে। এবার প্রায় ২০ শতাংশ কাছাকাছি ভোটের ব্যবধানে এই আসন থেকে জয়লাভ করে কংগ্রেস নেতা সিদ্ধার্থ শংকর রায়। তবে ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনে এই আসনটিতে জয়লাভ করে ভারতীয় লোক দল। দেশ এবং রাজ্যে জাতীয় কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে এই সময় উঠে আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি, তারই মধ্যে অন্যতম ভারতীয় লোক দল। উৎকল কংগ্রেস, ভারতীয় ক্রান্তি দল, সম্মিলিত সমাজতান্ত্রিক দলসহ বিভিন্ন জনবাদী রাজনীতির দলগুলি মিলিত হয় এই ভারতীয় লোকদল গঠন করেছিলেন।
মহম্মদ হায়াত আলি ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেসকে প্রথমবারের মত পরাজিত করেন। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে ফেল জাতীয় কংগ্রেসের (ইন্দিরাপন্থী) পক্ষ থেকে গোলাম ইয়াজদানি এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করে ১ হাজারের কাছাকাছি বেশি ভোটের মার্জিনে। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও গোলাম ইয়াজদানি জয়লাভ করেন এই কেন্দ্র থেকে। এই সময়কালে সিপিআইএম-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে থাকলেও লোকসভা নির্বাচনগুলিতে ভোট শতাংশের নিরিখে জাতীয় কংগ্রেস উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়েছিল। ১৯৮৯ সালে ওই কেন্দ্রটি জাতীয় কংগ্রেস তাদের দখলেই রেখেছিল। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের জন্য জাতীয় কংগ্রেসকে হারিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া এই কেন্দ্রে জয়লাভ করে ৪ শতাংশের কাছাকাছি ভোটের ব্যবধানে। ইউপিএ ও এনডিএ জোটের তুলনায় পশ্চিমবাংলায় ভালো ফলাফল করে থার্ড ফ্রন্ট। প্রায় ৩৭ টি আসন পায় তারা। এর মধ্যে সিপিআইএম ২৭টি, আরএসপি ৪টি, সিপিআই ৩টি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ৩টি আসনে জয়লাভ করেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে রাজ্যজুড়ে জাতীয় কংগ্রেসের বিজিত আসন সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯টি। তবে রায়গঞ্জ কেন্দ্রটিতে সিপিআইএমের সুব্রত মুখার্জি ফের জয় লাভ করেন আরও একবার।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও ভোট শতাংশ কিছুটা কমলেও সুব্রত মুখার্জি সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালে আরও একবার এই আসনটি সিপিআইএমের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় জাতীয় কংগ্রেস। এই কেন্দ্র থেকে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি জয়লাভ করেন। এই প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সদ্য জন্ম নেওয়া তৃণমূল কংগ্রেস, তারা ৮টি আসন পায়। রাজ্যে বামপন্থী দলগুলির সম্মিলিত আসন সংখ্যা ২৮-এ দাঁড়ায়৷ জাতীয় কংগ্রেস আসন সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩টি। ১৯৯৯ ও ২০০৪ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে জয়লাভ করেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির অসুস্থতা এবং রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার পরে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আসনটি থেকে সাংসার হিসেবে জয়লাভ করেছিলেন দীপা দাশমুন্সি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস এবং সিপিআইএমের বিপর্যয়ের পাশাপাশি রাজ্য জুড়ে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির জোর টক্কর হয়। এর মধ্যে ব্যতিক্রমী ভাবেই রায়গঞ্জ আসনটি থেকে জয়লাভ করেন মহম্মদ সেলিম। দীর্ঘদিনের কংগ্রেসের গড় রায়গঞ্জ আসনে ২০১৯ সালে পদ্মফুল ফোটাতে সক্ষম হন দেবশ্রী চৌধুরী। তিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রায় ৬০ হাজারের অধিক ভোটে পরাজিত করে এই আসনটি ছিনিয়ে নেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আসনটি থেকে বিজেপি জয়লাভ করলেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাদের পুরনো জমি পুনরুদ্ধারে কিছুটা সফল হয় তৃণমূল কংগ্রেস। গোয়ালপোখর, চাকুলিয়া, করমদিঘি, হেমতাবাদ এবং ইসলামপুরে তৃণমূল কংগ্রেস জয় লাভ করে কোথাও ১০ শতাংশের কাছাকাছি বেশি ভোটে, কোথাও ৪০ শতাংশ মার্জিনে। অন্যদিকে ভারতীয় জনতা পার্টির সৌমেন রায় এবং কৃষ্ণ কল্যানী জয়লাভ করে যথাক্রমে কালিয়াগঞ্জ এবং রায়গঞ্জ আসন দুটিতে। এই বিধানসভা ক্ষেত্রগুলির মধ্যে হেমতাবাদ এবং কালিয়াগঞ্জ তপশিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রতিফলন কতটা পড়ে ২০২৪ এর লোকসভায়, তা বলবে আগামীতে। বিজেপির বিধায়ক তৃণমূলের জন্য ভোটে লড়ায় কতটা সমীকরণ বদলায়, সেটার দিকেও সবার নজর থাকবে।