একদম ‘বাবার মতো’ই চিরবিদায় নিলেন শাঁওলি মিত্র। রবিবার দুপুর ৩টে ৪০ মিনিটে প্রয়াত হন তিনি। ইচ্ছাপত্রে শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র কন্যা জানিয়েছিলেন মৃত্যুর পর যেন দ্রুত তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।তারপর সকলকে জানানো হয় মৃত্যুসংবাদ। সেই ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়েছেন তাঁর প্রিয়জনেরা। মৃত্যুর পর কোনও ‘ফুলভার যেন বইতে না হয়’, চেয়েছিলেন শাঁওলি দেবী।
ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্পো’-এর বঙ্গবালা হিসাবে আজীবন বাঙালির মনে গেঁথে থাকবেন শাঁওলি মিত্র। তাঁর মৃত্যুর খবর যখন সহকর্মীদের কাছে পৌঁছেছে তখন তাঁর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গিয়েছে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের নাট্য মঞ্চের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ বিনোদন জগত। শাঁওলি মিত্রের স্মৃতি হাতড়ালেন তাঁর দেবশংকর হালদার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, সুদীপ্তা চক্রবর্তীরা।
এক সাক্ষাত্কারে দেবশংকর হালদার জানিয়েছেন, খুব কাছ থেকে শাঁওলি মিত্রকে দেখলেও এখটা সম্মানের দূরত্ব বারবার বজায় ছিল। শাঁওলি মিত্রর অভিনয় থেকে রঙ্গমঞ্চে অভিনয় শিখেছেন তিনি। তাঁর কথায়, 'উনি যখন অভিনয় করতেন আমরা হাঁ হয়ে দেখতাম আর শিখতাম অভিনয় কাকে বলে বা কোন পথে অভিনয় যেতে পারে। অভিনয় কোথায় কোথায় আমাদের স্পর্ধিত করে, শিখিয়ে দেয় কী কী করার আছে সেটা শাঁওলি মিত্রের অভিনয় দেখেই শেখা। শাঁওলি মিত্র আমাদের কখনও হাতে ধরে অভিনয়ের ক্লাস করাননি কিন্তু অভিনয় দিয়ে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন একের পর এক পাঠ।'
প্রিয় ‘শাঁওলি পিসি’-কে হারিয়ে বাকরুদ্ধ সুদীপ্তা চক্রবর্তী। অভিনেত্রী ফেসবুকে ভাগ করে নেন নিজের যন্ত্রণা। লেখেন, ‘অনেক আদর পেয়েছি, অনেক ভালোবাসা...অনেক কিছু শিখেছি... মঞ্চাভিনায়ের খুঁটিনাটি...অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছি তাঁর অভিনয়, সেই ছোট্টবেলা থেকে...নাথবতী অনাথবৎ...কথা অমৃত সমান...আমার নাটক দেখে ফোন করে খুব প্রশংসা করেছিলেন। আনন্দে কেঁদেই ফেলেছিলাম। বড় হয়ে একসঙ্গে একটা কাজ করার আর্জি নিয়েও গিয়েছিলাম...সিনেমায়। করেননি। তাই আর একসঙ্গে কাজ করার বা একদম সামনে থেকে অভিনয় দেখার সৌভাগ্য হলো না.... বেহালার বাড়িতেই শেষ দেখা...কত আদর করে কত কি খাইয়েছিলেন...আমি যে তাঁর বন্ধু বিপ্লবকেতনের মেয়ে.. চলে গেলেন আমার শাঁওলি পিসি...বাংলা মঞ্চের নক্ষত্র পতন !!! একটা যুগের, একটা অভিনয়ের ধারার ধারক ও বাহক....কানে বাজছে সেই সুরেলা গলায় বলা সংলাপ...মহাভারতের কথা অমৃত সমান.......’।
বাংলা নাট্যজগতের অপর কিংবদন্তি রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত প্রিয় সহকর্মীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘শাঁওলিরা তো আর পুরোপুরি চলে যায় না। না থেকেও তাঁরা থেকে যায় নিজেদের কাজের মধ্যে, আলোচনায়, মননে। শাঁওলির সঙ্গে শুধু সহ অভিনেত্রী হিসেবে সম্পর্ক ছিল না। বরং ব্যক্তিগত স্তরেও সম্পর্ক ছিল। সকলে মিলে একসঙ্গে কাজ করেছি। গ্যালিলিওতে অভিনয় করেছি। খুব হইহই হত। স্বাতীলেখা, শাঁওলি, বিভাস, অরুণ, আমি সবাই একসঙ্গে কাজ করতাম। স্বাতীলেখার পর শাঁওলিও চলে গেলেন। যাঁদের যাওয়ার কথা নয়, তাঁরা চলে যাচ্ছেন। আমার মতো মানুষের কাছে এটা খুবই বেদনাদায়ক। আমার ৮৬ বছর বয়স হয়ে গেল। তাও আমি রয়ে গেলাম’।
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও স্বাতীলেখা কন্যা সোহিনী সেনগুপ্ত খুব কাছ থেকে দেখেছেন শাঁওলি মিত্রকে। দিন কয়েক আগেও তাঁর কথা হয়েছে ‘শাঁওলি মাসি’র সঙ্গে। তিনি হতবাক এমন একটা দুঃসংবাদ পেয়ে। পুরোনো স্মৃতি ভাগ করে নিয়ে এক সাক্ষাত্কারে অভিনেত্রী জানান, ‘আমার ছোটবেলাটা জুড়ে একটা ইম্পরট্যান্ট পার্ট ছিলেন তিনি। কত কোলে করে ঘুরে বেরিয়েছি। মাঝখানে যখন অসুস্থ হল তখনও দেখা হয়েছিল। আমায় বলল, বাবুয়া (সোহিনীর ডাকনাম) শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।’